অভ্যুত্থানকারীদের ওপরও দুর্নীতির ‘আছর’

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, যা স্থান পায় গ্রাফিতিতে।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, যা স্থান পায় গ্রাফিতিতে।

আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতি নিয়ে যারা সবচেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ, অভ্যুত্থানের সেই তরুণরা এখন ক্ষমতাবান হয়ে নানা দুর্নীতি জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

নানা অভিযোগ ওঠার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনের চাকরির অবসান ঘটেছে।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহাম্মদ তুহিন ফারাবীকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগের মুখে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

গত জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার হটানোর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরাই এনসিপি গড়ে তোলে।

এই দলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের নিজ এলাকায় গাড়িবহর নিয়ে মহড়া এরই মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দলের মধ্যেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তাদের নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, এই তরুণদের ওপর জিনের আছরের মতো ক্ষমতার আছর পড়েছে।

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা বনে যাওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া তার এপিএস বানিয়েছিলেন তাদের আন্দোলনের সঙ্গী মোয়াজ্জেম হোসেনকে।

মোয়াজ্জেম ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। নিজ এলাকা মাগুরায় জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন (বাঁয়ে) ও তুহিন ফারাবী।

নয় মাস পর সোমবার এপিএসের চাকরি থেকে মোয়াজ্জেমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অব্যাহতির কারণ হিসাবে প্রজ্ঞাপনে কিছু বলা না হলেও তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

সেই কারণে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশ হলেও উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, মোয়াজ্জেমকে অপসারণ করা হয়নি, তিনি পদত্যাগ করেছেন।

তবে তিনি একইসঙ্গে বলেছেন, মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ থাকলে তা অভিযোগ আহ্বান সংক্রান্ত ইমেইলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।

মোয়াজ্জেম অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তিনি এপিএসের এই অস্থায়ী চাকরি ছেড়েছেন স্থায়ী চাকরির আশায়। কারণ তিনি ব্যাংকে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা এবং বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহাম্মদ তুহিন ফারাবীর বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে।

প্রথম আলো জানিয়েছে, তাকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি অফিস করছেন না। উপদেষ্টার দপ্তর থেকে তাকে অফিসে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।

গত বছরের ২ অক্টোবর তুহিন ফারাবীকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলায়।

তুহিন ফারাবী কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মেডিকেল দলের সদস্য।

সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য কিংবা চাঁদাবাজির মতো অভিযোগও উঠছে এনসিপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধেও।

গাজী সালাউদ্দিন তানভীর।

পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়।

গত মার্চ মাসে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগও ওঠে তানভীরের বিরুদ্ধে।

তানভীর তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সংবাদ সম্মেলন করে অস্বীকার করলেও শুক্রবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় এসব অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

আলোচনার পর গত রোববার রাতেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে শৃঙ্খলা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

সোমবার রাতে যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি ও কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়।

কী বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা?

তানভীরকে বহিষ্কারের বিষয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কারো বিরুদ্ধে যখন কোনো অভিযোগ ওঠে, তখন তার স্বপক্ষে প্রমাণ থাকতে হয়। তানভীরের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কোনো উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় এতদিন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।”

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা ছিলেন সবচেয়ে উচ্চ কণ্ঠ, তারা কেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে, এই প্রশ্নে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান আমাদের ভেতরও আসার চেষ্টা করছে।”

রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই ছাত্রনেতাদের বয়স কম, কিন্তু তাদের ম্যাচিউরিটিরও দরকার আছে। তাদের পরিণত আচরণ করা উচিৎ। তা না হলে তাদের এসব ভুলের সুযোগ নেবে প্রতিপক্ষরা।”

অভিযোগ উঠলে সেটাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে বলে দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ।

তিনি বলেন, “আমাদের কারো বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের আর্থিক অনিয়ম, চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির বিষয়ে প্রমাণ পেলে যেন আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। আমরা এ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”

নাহিদ বলেন, “আমরা হয়তো নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটির মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। এটা আমরা অস্বীকার করি না। তবে যারা আমাদের সমালোচনা করছে, তারাও চায় আমরা ভালো করি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads