বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকায় কঠোর নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যেই কোথাও কোথাও পুড়ছে যানবাহন, মিছিলে আর স্লোগানে চলছে দলটির মহড়া।
আওয়ামী লীগ অবশ্য বলছে, পুলিশের এই ‘রুখে দেওয়ার ঘোষণা’ উল্টো জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে তাদের কর্মসূচিকে কার্যত সফল করে তুলেছে।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন তারা এ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে জানানো হয়েছে, যা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি নিউজ এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ড সরাসরি সম্প্রচার করবে।
গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নাশকতার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দলটির দাবি, “সরকার তাদের মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য।”
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, এমন ধারণা পোষণ করতে শোনা গেছে বিএনপির একাধিক নেতাকেও।
বুধবার সকালে গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলো শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যে কেউ ঘটাতে পারে।
খসরুর ভাষ্য: “আওয়ামী লীগ নির্বাচনের রেইসেও নেই, তাদের কার্যক্রম স্থগিত। এরকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ কেন, যে কেউ ঘটাতে পারে।”
এই জ্যেষ্ঠ নেতার ইঙ্গিত যে জামায়াতের দিকে তা না বললেও স্পষ্ট।

আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মিছিল, টায়ার পোড়ানোর মতো নির্দেশনা থাকলেও যেকোনো ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে চলতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, তাদের বাড়ি-ঘর, দলীয় অফিস কিছুই বাদ যায়নি হামলা থেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সবই আগুনে পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগের ওপরও আসে নিষেধাজ্ঞার খড়গ।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কারাগারে, কেউ বিদেশে পালিয়ে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আছেন ভারতে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করে বিচার এগিয়ে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই রায় কবে হবে, তার দিন ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর।
যদিও এই বিচারকে ‘সাজানো’ আখ্যায়িত করে ইতোমধ্যে জাতিসংঘে নালিশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি ১৩ তারিখ লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
বিদেশে অবস্থানরত দলটির মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলছেন, “ক্যাঙ্গারু কোর্ট বানিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ভুয়া রায় দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধেই” তারা লকডাউন কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছেন।”
পুলিশের হিসেব অনুযায়ী, গত এগার দিনে পনেরটি জায়গায় ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, আর গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে।
তবে এ নিয়ে জনমনে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “১৩ নভেম্বর নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। ঢাকার মানুষ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আমরা সবাই মিলে এটি রুখে দিবো। ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রোববার বিকালেও বলেছিলেন, তারা শঙ্কিত নন। যদিও রাতেই তার নিশঙ্কভাব উধাও হয়ে যায়। হঠাৎ করেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয় সেদিন। মেট্রোরেলের সবকর্মীদের ছুটি বাতিলের ঘোষণাও আসে।
আওয়ামী লীগের ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জেলা থেকে লাখেরও বেশি নেতাকর্মী ঢাকায় জড়ো হয়েছেন- এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তা নিয়ে আলোচনার পরই নড়েচড়ে বসে সরকার, আর আসতে থাকে একের পর এক নতুন নতুন সিদ্ধান্ত।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম অনেকটা এরকম- “যেকোনো উপায়ে সফল করা হবে ঢাকা লকডাউন কর্মসূচি”।
ঢাকায় আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নেন মোহাম্মাদ জুয়েল নামে এক কর্মী। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শহরকে থমকে দেওয়া— গাড়ি পোড়ানো বা কারও ক্ষতি করা নয়। যদিও সরকার নিজেরাই আগুন লাগিয়ে দোষ আমাদের উপর চাপিয়ে জনগণের নজর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে। যেটাই হোক, আমরা মনোবল হারাচ্ছি না।”
আওয়ামী লীগ সাংগাঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আমাদের কর্মসূচি জনগণের শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফল হবে। কিন্তু সরকার আতঙ্ক ছড়িয়ে জনগণকে ঘরবন্দি করার নকশা সাজিয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস গংদের মেটিকুলাস ডিজাইনের সঙ্গে দেশবাসী এখন আর অপরিচিত নয়।”
এদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বুধবার থেকেই দেখা গেছে যানবাহনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ফার্মগেট, শাহবাগ, মিরপুর রোড, বাড্ডা, উত্তরা— সব জায়গাতেই ট্রাফিক তুলনামূলক স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে চাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অলিখিত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জনাসমাগম ও বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৩ তারিখের পাঠদান বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে, কোনটি ক্লাস নেবে অনলাইনে।
তবে বাংলাদেশ দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ও ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির স্থায়ী কমিটির যৌথ সভায় দোকানপাট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও মিরপুর রোডের বেশ কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বললে তারা দোকান খুলবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত নেননি বলে দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, “ওনারা ওনাদের স্বার্থে সরকারের চাপিয়ে দাওয়া নানা সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভেতরের চিত্র ভিন্ন। নিজের ক্ষতি করে দোকান খোলা রাখবে কোন পাগলে?”
মিরপুর রোডের বাসচালক বাবর উদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি জানেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, কী বলেন ভাই। দ্যাখতাছেন না রাস্তাঘাটে মানুষ নাই। যাত্রীও নেই। সবাই ভয় পাইছে। তয় আমরা এখন বুঝি জ্বালাও পোড়াও কারা করে; চৌদ্দ সালেও দেখছি, এখনও দেখতাছি। আমি কাইল বাস চালামু না। দেখা যাইব সরকারের লোকজন গাড়িতে আগুন দিয়া দিছে!”
বাবর উদ্দিনের কথাই যেন বললেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জনগণ এখন সরকারের ভয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে নীরবে প্রতিরোধ করছে। শহর থেমে যাওয়া মানে আমাদের কর্মসূচি সফল হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শেখ হাসিনার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দুদিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে যা হচ্ছে তাতে মানুষের আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক।
“রায় হলে আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে যাবে। তাই তারা এটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে আতঙ্ক তৈরি করতে চাইলে সেটি ঠেকানো কঠিন। ২০১৩-১৪ সালেও এমন দেখা গেছে। ৫ই অগাস্টের পর রাজনৈতিক মীমাংসার দিকে যাওয়া হয়নি। দুই তরফেরই রিকনসিলিয়েশন না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যা চলবে। পুলিশ দিয়ে সমাধান হবে না।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর:



