নেপালে জেন বিক্ষোভে সরকার পতনের পর যখন তার সঙ্গে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের মিল খুঁজে বেড়াচ্ছে সবাই, তখন নেপালের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অমিল প্রকট হয়ে ধরা দিল।
নেপালের রাষ্ট্রপতি নয়ই সেপ্টেম্বর রাতে যে ‘হিম্মত’ দেখিয়েছিলেন- এমন শিরোনামে সোমবার বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই অমিলটি ধরা পড়ে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েল চাপের মুখেও পদত্যাগ না করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন শক্ত হাতে, ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন গণতন্ত্র নস্যাতের চেষ্টা। সেজন্য মৃত্যুর ঝুঁকিও নিয়েছিলেন।
ঠিক এক বছর আগে এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পুরোপুরি নতি স্বীকার করেছিলেন। তারপর এখন রাষ্ট্রপ্রধানের পদে থেকেও যেন তিনি নেই।
দেড় দশক ধরে নানা কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগের বহু সমালোচনা থাকলেও গত বছর তরুণদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়ার পর বাংলাদেশ যে ভালো আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরই।
গণতন্ত্রের বদলে অরাজক এক পরিস্থিতি গড়িয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘মবতস্ত্র’। নেপালে আগামী মার্চ মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এক বছরেও নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটাতে পারছে না।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানে গত বছরের জুলাইয়ে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেখানে নেতৃত্বে ছিল ‘জি’ প্রজন্ম বা জেন জি; যা এখনও ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে শোভা পাচ্ছে।
গত বছরের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এসে ঘোষণা দেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে।
বঙ্গভবনে থাকা রাষ্ট্রপ্রধান সাহাবুদ্দিনের কোনো তৎপরতার কোনো খবরই তখন পাওয়া যায়নি। এরপর রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে সাহাবুদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন।
তার ওই ভাষণ দেওয়ার সময় পেছনে ছিলেন জেনারেল ওয়াকারসহ তিন বাহিনী প্রধান। ভাষণ পড়ে গেলেও রাষ্ট্রপতির মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ছিল স্পষ্ট। এমনকি ভাষণ শেষের পর তিনি সেনাপ্রধানের দিকে তাকাচ্ছিলেন অনুমোদন চাওয়ার ভঙ্গীতে, অথচ তিনিই সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।
এরপর অভ্যুত্থানকারীদের নানা দাবি মেনে আদেশ জারি করতে থাকেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন, সংসদ ভেঙে দেন, স্পিকারের পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথাও জানান।
এসব কাজ তিনি যে নিজের ইচ্ছায় করছেন না, তা পরে প্রবীণ সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর এক লেখায় উঠে আসে। মতিউর রহমানের দাবি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন যে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র তিনি দেখেননি; অথচ জাতির সামনে ভাষণে সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা জানিয়েছিলেন।
প্রয়োজনীয় সব কাজ হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে সাহাবুদ্দিনকে সরানোর দাবিও উঠেছিল অভ্যুত্থানকারীদের মধ্য থেকে; তবে বিএনপির বিরোধিতায় তা ফলতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০২৩ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সাহাবুদ্দিন। পাঁচ বছরের মেয়াদ হিসেব করলে ২০২৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তার এই পদে থাকার কথা। কিন্তু এখন তিনি আছেন না থাকার মতোই।
তিনি যে গুরুত্বহীন, তা অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন দেশ সফর থেকে ফিরলেও রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন না। জাতীয় দিবসগুলোতেও রাষ্ট্রপতির কর্মকাণ্ডের খবর সরকারি প্রচার মাধ্যমে আসছে না।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা বাসসে আগে জাতীয় খবরে সবচেয়ে ওপরের সেকশনটি ছিল রাষ্ট্রপতির জন্য। এখন সেখানে সবার ওপরে ‘প্রধান উপদেষ্টার সংবাদ’, তারপর ‘জাতীয় সংবাদ’, ‘শীর্ষ সংবাদ’ এর পরে ‘রাষ্ট্রপতি’ নামে সেকশনটি এখন রয়েছে। সেখানে সংবাদ হাতেগোনা কয়েকটি।
দেশকে গণতন্ত্রে ফেরাতে নির্বাচন কবে হবে, সেই বিষয়েও রাষ্ট্রপতির কোনো নির্দেশনা নেই। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসই এবিষয়ে কথা বলছেন। এক বছর বাদে তিনি জানিয়েছেন, আরও সাত মাস পরে আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
তবে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখের ঘোষণা না আসায় সেই নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সবার মনেই। অথচ নেপালে সরকার পতনের দুদিন বাদেই অন্তর্বর্তী সরকারকে শপথ করিয়ে আগামী ৫ মার্চ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন সেদেশের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েল।
বাংলাদেশের মতো নেপালেও সরকার পতনের ব্যাপক ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ হয় সরকারি ও ঐতিহাসিক নানা স্থাপনা এবং রাজনীতিকদের বাড়ি-ঘরে।
সেই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন রাজতন্ত্র ফিরে আসার গুঞ্জন চলছিল, খবর ছড়াচ্ছিল রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েলও পদত্যাগ করেছেন।
কাঠমান্ডুর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কিশোর নেপাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, যখন কাঠমান্ডুর সব বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন মনে হচ্ছিল যে নেপাল বোধহয় আবারও রাজতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে।
“কাঠমান্ডুর রাজকীয় প্রাসাদ নারায়ণহিতিতে জ্ঞানেন্দ্র (সাবেক রাজা) ফিরে আসার কথা শোনা যাচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েলকে সেনাবাহিনী ইস্তফা দিতে বলেছিল কিন্তু রাষ্ট্রপতি বিচক্ষণতা দেখিয়েছিলেন সেদিন।”
কী ঘটেছিল সেদিন, তা তুলে ধরে কিশোর নেপাল বলেন, “সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতিকে বলেন- ‘আপনি পদত্যাগ করে দিন, বাকিটা আমরা সামলে নেব’। তখন রাষ্ট্রপতি বলেন- ‘আমি পদত্যাগ করব না, আপনি বরং আমাকে খুন করে দিন আর জেন জির আন্দোলনকারীদের ওপরে হত্যার দায় চাপিয়ে দিন। এরপরে আপনি যা করার করবেন’।”
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের এই কথোপকথনটি জেনেছেন বলে জানান সাংবাদিক কিশোর।
তিনি বলেন, “আমি এই খবরের সূত্রটা বলব না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে প্রধানমন্ত্রী ওলিও কিন্তু সেনাপ্রধানের কথামতোই ইস্তফা দিয়েছিলেন। ঠিক একইরকম চাপ ছিল রাষ্ট্রপতির ওপরেও।
“যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করে দিতেন, তাহলে নেপাল সেনা শাসন বা রাজতন্ত্রের দিকে ঘুরে যেত। রাষ্ট্রপতি সত্যিই হিম্মত দেখিয়েছেন।”
নেপালের আরেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কনক মণি দীক্ষিত বিবিসিকে বলেন, “গণতন্ত্রের প্রতিটা স্তম্ভই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজকীয় প্রাসাদ নারায়ণহিতিতে কেউ হাত পর্যন্ত দেয়নি। জ্ঞানেন্দ্রর বাসভবনও সুরক্ষিত থেকেছে।
“এই পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র নিয়ে মনে তো একটা আশংকা তৈরি হচ্ছেই। তবে আমিও মনে করি যে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।”
নেপালের সুপরিচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক সি কে লালও প্রশংসা করছেন রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্রের ভূমিকার।
আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্ব দেওয়া রাকশা বমও প্রশংসা করছেন রাষ্ট্রপতির। নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগডেল গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে জেন জির যে প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন, তাদের মধ্যে রাকশা বমও ছিলেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “সেনাপ্রধান বলেছিলেন যে আপনারা নিজেদের দাবি আমাকে বলুন, আমিই রাষ্ট্রপতির কাছে সেগুলো পৌঁছিয়ে দেব। সেনাপ্রধানকে আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব না, কারণ আমরা বেসামরিক সরকার গড়তে চাই। তাই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করব আমরা।”
রাকশ বম মনে করেন, রাষ্ট্রপতি যদি বিচক্ষণতা আর সাহস না দেখাতেন, তাহলে নেপাল হয় সামরিক শাসন অথবা রাজতন্ত্রের হাতে চলে যেতে পারত।
জ্বালাও-পোড়াও নিয়ে তিনি বলেন, “সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা তো আমার একেবারেই পছন্দ না। আসলে ৯ সেপ্টেম্বরের আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল।”
জেন জি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা নেপালের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইন্দিরা অধিকারী বিবিসিকে বলেন, “জেন জির সঙ্গে আলোচনার সময়ে সেনাপ্রধান রাজতন্ত্রের সমর্থক দুর্গা প্রসাই, রবি লামিছানের দল আরএসপি এবং রাজতন্ত্রের সমর্থক আরেকটি দল আরসিপিকেও ডেকে নিয়েছিলেন।
“এরপরই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি যে আসলে কী হতে চলেছে! আন্দোলন তো জেন জির ছিল, কিন্তু সেনাবাহিনী রাজতন্ত্রের সমর্থকদেরও আলোচনায় কেন ডেকে নিল? আমি এই যুবক-যুবতীদের বলেছিলাম যে তোমাদের বিশেষ গুরুত্ব দেবে না এরা, তাই নিজেদের প্রতিনিধি পাঠাও। এর পরেই সুশীলা কার্কির নামে সকলে একমত হল।”
তার কথায়, “সুশীলা কার্কিকে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরাটা একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিল এবং সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে রাষ্ট্রপতির সহায়ক হয়ে উঠল এই সিদ্ধান্ত।”