বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাড়তে গিয়ে ছড়াচ্ছে দ্বন্দ্ব

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষ মুখোমুখি।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষ মুখোমুখি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানেই পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার দেড় দশকের সরকারের। সফল অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পর গঠিত হয় এই প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক কমিটি। পাঁচ মাস পর তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ যখন শুরু হলো, তখন তা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দ্বন্দ্বের খবর আসছে।

শনিবার চট্টগ্রামে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের পর এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর চড়াও হয়। একই দিন মানিকগঞ্জে দুই পক্ষের মারামারিতে আহত হয়েছেন অন্তত দুজন। তার আগের দিন ঢাকার মিরপুর থানা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাংলামটরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েই সংঘর্ষে আহত হন তিনজন।

এছাড়া গত কয়েকদিনে কমিটি নিয়ে আরও কয়েকটি জেলায় রেষারেষির খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। দুই-একটি জেলায় কারও কারও পদত্যাগের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন সারাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। এরমধ্যেই চট্টগ্রামে দুই পক্ষের বেঁধে যায়। এরপর দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনের তিন নেতার বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ রাসেল আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র’র পক্ষে বিকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ শেষে তারা ওয়াসায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসকক্ষে আলোচনার জন্য বসেছিলেন। সেখানে কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদও ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক রিজাউর রহমান সেখানে এসে হান্নানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

“একপর্যায়ে খান তালাত মাহমুদ, রিজাউর ও সাদিক আরমানের নেতৃত্বে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। আমাদের নেতা-কর্মীদের মারধরও করা হয়। এতে সাতজন আহত হয়েছেন।”

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়ক তানভীর শরিফও ছিলেন।

তাদের সংবাদ সম্মেলন করার সময় প্রেস ক্লাবে এসে হাজির হন কেন্দ্রীয় সহ সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি ও রিজাউর রহমান। এসময় হট্টগোল বেঁধে যায়। এক পর্যায়ে রাসেলসহ তার সমর্থকরা উঠে যান।

এসময় রাফি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে স্লোগান দিতে দিতে আবার হলে ঢোকেন রাসেলরা। তারা রাফির কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নেন। পরে দুই পক্ষই সংবাদ সম্মেলন শেষ না করে প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে যান।

রাসেলের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তালাত মাহমুদ বলেন, তারা কাউকে অবরুদ্ধ করেননি। আলোচনা করার সময় বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছিল। এর বেশি কিছু হয়নি।

রিজাউর দাবি করেন, উল্টো রাসেলের সমর্থকরা তাদের পক্ষের চারজনকে মারধর করেছে।

শনিবার সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জের বেউথা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের দুই পক্ষের মারামারিতে মেহেরাব খান ও মিরাজ হোসেন নামে দুই ছাত্র আহত হন।

সেখানেও লিফলেট বিতরণের পর ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি খাবারের দোকানে কর্মিসভা করছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ইসমাইল হোসেন রুদ্র। তার উপস্থিতিতেই মারামারি বাধে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছে।

মানিকগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে একটু মতবিরোধের ঘটনা ঘটেছিল। তখন সদর থানার ওসি গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন।

ঢাকার মিরপুরের সাতটি থানা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কমিটি ঘোষণা করা হয় বৃহস্পতিবার। তারপর থেকে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল।

এরমধ্যেই শুক্রবার রাতে রূপায়ন টাওয়ারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুই পক্ষের মারামারিতে তিনজন আহত হন বলে বাংলা ট্রিবিউন জানিয়েছে।

আহতদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা হলেন- মিরপুর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিয়ান (১৬), রনি (২১) ও সাফরান (২২)।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক জাহিদ আহসান বলেন, “রাতে আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কিছু লোক এসে কমিটিকে যুক্ত হতে নেতাকর্মীদের চাপ সৃষ্টি করে। তারা জোর করে কমিটিতে যুক্ত হতে চেয়েছে। তবে আমাদের মতাদর্শের সঙ্গে তাদের কমিটিতে নেওয়া যাচ্ছে না। পরে আমাদের কেন্দ্রীয় কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডায় একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।”

এই মারামারির কারণে রাত ৮টায়ই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যালয় সেদিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, চাঁদাবাজির অভিযোগও আসছে।

কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই গড়ে উঠেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারের দমন-পীড়নের মুখে দুই সপ্তাহ পর তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ৩৬ দিনের মধ্যে বিজয় আসে, ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

আন্দোলনের সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য থেকেই কেউ কেউ এই প্ল্যটফর্ম অবলুপ্তির সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু পরে কিছু কারণ দেখিয়ে এই প্লাটফর্ম সচল রাখার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা।

তার মধ্যে রয়েছে, পাল্টা অভ্যুত্থান ঠেকানো, অভ্যুত্থানে হতাহতদের চিকিৎসাসহ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এখন ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিচ্ছে তারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের একটি আওয়াজ শুরুতে ‍উঠলেও পরে সমন্বয়করা তা নাকচ করে দেন। এই প্ল্যাটফর্মের সহযোগী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’, তারা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াসে রয়েছে। সেখান থেকে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সংস্কারের দাবিও তোলা হচ্ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনায় গত ৯ জুন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের মাসে ব্যানার বদলে নাম হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।

ডাকসুর সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও ভিপি নুরুল হক নুরের এক সময়ের সহযোগী আখতার হোসেনের গড়া সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির নেতারাই মূলত এই প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। ৫ আগস্টের পর গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি বিলুপ্ত করেন আখতার, তিনি এখন নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব।

আন্দোলনের শুরুতে নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন সমন্বয়নের দায়িত্ব পালন করতেন। পরে সমন্বয়ক টিমে সদস্য বাড়ানো হয়। প্রথমে সমন্বয়ক টিমে ৬৫ জন সদস্য থাকার কথা জানানো হয়েছিল। ৩ আগস্ট সদস্য সংখ্যা ১৫৮ জন করা হয়।

সমন্বয়কদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে যোগ দেন। এরপর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফোরামে তারা থাকছেন না।

অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পর গত বছরের ২২ অক্টোবর সমন্বয়ক কমিটিকে আহ্বায়ক কমিটিতে রূপ দেওয়া হয়। আহ্বায়ক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসনাত আব্দুল্লাহকে, সদস্য সচিব করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ সোহেলকে। চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল হান্নান মাসউদকে মুখ্য সংগঠক এবং উমামা ফাতেমাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেও তিনি নানা কর্মসূচিতে থাকছেন।

আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দিয়ে সারজিস সেদিন বলেছিলেন, “আগামীতেও এই সংগঠনের অনেক কাজ করতে হবে। এজন্য সংগঠনকে সারাদেশের জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। এজন্য আরও সুসংগঠিত হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্টদের প্রতিহত করতে হবে।”

৫ আগস্টের পর কেউ কেউ যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলোপের পরামর্শ দিয়েছিল, তখন হাসনাত আব্দুল্লাহ এই প্ল্যাটফর্ম টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, “ছাত্র-জনতা দেশের সিস্টেমের সংস্কার চায়। গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তাকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করার জন্যও আমাদের মাঠে থাকতে হচ্ছে।

“আমরা এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। যতদিন না এই কাজ চলবে এবং চালানোর প্রয়োজন থাকবে, ততদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাঠে থাকবে।”

আরও পড়ুন