আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও তীব্র সমালোচনা করেছেন মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের।
শুক্রবার রাতে এক উন্মুক্ত পাবলিক ফোরামে দেওয়া বক্তব্য তিনি বলেন, “যারা বলে ইউনূস নির্বাচন দিবে, তারা আহাম্মকের স্বর্গে বসবাস করে।”
এই বক্তব্য তিনি একটি গ্রুপ অডিও কলের মাধ্যমে দেন, যেখানে সরাসরি অংশগ্রহণ করে প্রায় ২৮ হাজার মানুষ।
বাংলাদেশে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। একদিকে সংবাদ মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ, সাংবাদিক ছাঁটাই অন্যদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির আভাস —সব মিলিয়ে দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই উদ্বেগজনক।
এই প্রেক্ষাপটেই শেখ হাসিনা সরাসরি ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন এবং তাকে “নাটকবাজ” বলেও আখ্যা দেন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এরইমধ্যে তার নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ইউনূস কখনও বলেছেন নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হবে, আবার কখনও ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “দুদিন পর পর একটা ইস্যু তুলে সে। এখন তুলেছে, আমরা যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলে এক নতুন নাটক শুরু করেছে। নির্বাচনের প্রসঙ্গ যেন কেউ না তোলে, সেজন্যই এসব করছে।”
বক্তৃতায় শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইউনূসকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, “সে কত বড় নাটকবাজ, আমি জানি। বিভিন্ন সময় গরিবের জন্য টাকা চাইতে আসতো, সাহায্য চাইতো। আমি তাকে এবং গ্রামীণ ব্যাংককে সহযোগিতা করেছি। কান্নাকাটি, করুন মুখ—এসব তার পুরনো অভ্যাস।”
তিনি অভিযোগ করেন, ইউনূস ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য “যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব” দেখাচ্ছেন এবং তার কথিত মানবিক করিডরের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়েও কঠোর অবস্থান নেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শেষ করে দিয়েছে। করিডোরের নামে যা করছে, তা অমানবিক। ওই করিডোর দিয়ে মরনাস্ত্র যাবে মিয়ানমারে, যা লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশকে অন্য দেশের মানুষ হত্যায় ব্যবহার করতে দেওয়া যায় না।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই করিডোরের আড়ালে আন্তর্জাতিক সামরিক তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা থাকলেও বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও সীমান্তবর্তী দেশ এতে চরম বিপদের মুখে পড়তে পারে।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনা তার দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমি কোনো বিভাজন দেখতে চাই না। দেশের স্বার্থে, দশের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সময়টা বিভ্রান্ত হওয়ার নয়, ভুল পথে যাওয়ার নয়। আমাদের ঐক্য, সাহস আর দেশপ্রেমই সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলার প্রধান শক্তি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার এই বক্তব্য রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি কৌশলগতও। তিনি একদিকে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে ইউনূস সরকারের প্রতি জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
তিনি বারবার নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে আনার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, বর্তমান সরকার নির্বাচন নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’ তৈরি করছে। ২০২৫ নাকি ২০২৬—এই বিভ্রান্তির আড়ালে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া বা বাতিল করার আশঙ্কা রয়েছে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার বক্তব্যে।
শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত করিডোরের বিরুদ্ধেও তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এটিকে মানবিক উদ্যোগ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে এলেও শেখ হাসিনা এটিকে সামরিক হস্তক্ষেপের একটি কৌশল হিসেবে তুলে ধরেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিভক্তি ও প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে তিনি তার দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে যে ‘ঐক্যবদ্ধ’ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, তা দলকে পুনরায় সংগঠিত করতে এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে।