সংস্কার খাচ্ছে ধাক্কা, ভোটের কী হবে

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ধরে চলছে বিতর্ক, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই জনপ্রশাসন থেকে শুরু হয় তার বিরোধিতা, এখন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি এসেছে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘটা করে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনগুলোর চারটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর সর্বশেষ রোববার নির্বাচন সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি এল।

ইউনূস সরকার সংস্কার শেষে নির্বাচন চাইলেও তা বাস্তবায়ন শেষ করতে গেলে নির্বাচন যে পিছিয়ে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর তা বুঝে দ্রুত নির্বাচনের আওয়াজ তুলছে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।

বিএনপি তো এটাও বলছে যে, জুলাই-আগস্ট মাসেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। দেশের স্বার্থে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে অনির্বাচিত সরকারের বিদায় নেওয়া উচিৎ, এমন মত দলটির নেতাদের।

তারপরও দ্রুত নির্বাচনের পথে এগোনোর চাইতে সংস্কারকেই প্রাধান্য দিতে চাইছেন ইউনূস। তিনি দুদিন আগেই ডাভোসে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে, তা জনগণের চাওয়ার ওপর নির্ভর করবে।

ন্যূনতম সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে ইঙ্গিত করেন তিনি। এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির বলেছেন, ডিসেম্বরে ভোট করতে চাইলে আইন-কানুন, বিধি-বিধান ঠিক করে অক্টোবরের মধ্যেই প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।

সংস্কার নিয়ে যেখানে আপত্তি সিইসির

বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার ১১ দিন পর রবিবার ঢাকায় নির্বাচন ভবনে নির্বাচনকেন্দ্রিক সাংবাদিকদের সংগঠন আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান সিইসি নাসির।

গত বছর শেখ হাসিনার সরকার বিদায় নেওয়ার পর কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও পদত্যাগ করে। এরপর সাবেক আমলা নাসিরকে প্রধান করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হয়।

সিইসি নাসির নির্বাচন সংস্কার কমিশনের তিন সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তোলেন। তার মধ্যে তার বেশি আপত্তির জায়গাটি হলো বিদায় নেওয়ার পর ইসির বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে তদন্তের এখতিয়ার দেওয়া।

পাশাপাশি সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের যে সুপারিশ সংস্কার কমিশন করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে তার অভিমত।

অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে বরাবরই ‘সোনার হরিণ’ হয়ে থেকেছে। এই নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে; আবার বেশিরভাগকে সন্তুষ্ট করতে পারলেও সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং নির্বাচনের সময়টাতে তারা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী।

সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে বিশাল ক্ষমতা দিয়েছে, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও একমত। কিন্তু সমস্যা থেকে যাচ্ছে, প্রয়োগের বেলায়। একই আইনের অধীনে থেকে একেক ইসি একেকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে।

তাই বিশ্লেষকরা দাবি, সমস্যা যতটা না ইসির, তা চেয়ে বেশি ভোটের সময় কে থাকছে সরকারে, তার ওপর। সেই কারণেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা করা গেলেও দলীয় সরকারের অধীনে তা করা যায় না।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বিদায় বেলায় তার সময়ে নির্বাচনের ওপর প্রশাসন তথা সরকারের হস্তক্ষেপের কথা বললেও নির্বাচন পদ্ধতিতে মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করে গিয়েছিলেন।

বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি যে প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে, তার ১৫০টি সুপারিশের মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনাররা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এবং শপথ ভঙ্গ করলে মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর বিধান করতে হবে।

ভবিষ্যতে সংসদীয় আসন সীমানা নির্ধারণে আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংস্থা নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠনের সুপারিশও করে সংস্কার কমিশন।

এই তিনটি সুপারিশ নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন সিইসি নাসির। তিনি বলেন, “সব সুপারিশ ভালো বা খারাপ বা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, এটা বলতে পারছি না।”

সিইসি উদাহরণ হিসাবে বলেন, “যিনি জুতা পায়ে দেন, তিনি জানেন পেরেকটা কোথায় খোঁচাচ্ছে। জুতা পায়ে না দিলে বুঝতে পারবেন না, আসলে ব্যথাটা কোথায় লাগছে।”

ইসির চারটি ‘সাংবিধানিক ম্যান্ডেটের’ কথা তুলে ধরেন সিইসি, যেগুলো হলো- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সীমানা নির্ধারণ।

ভোটার তালিকা ও সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে ‘বিশাল একটা সমস্যা’ দেখা দেবে বলে সতর্ক করে সিইসি নাসির।

তিনি বলেন, “ডিলিমিটেশন (সীমানা পুনর্নির্ধারণ) উনারা সাজেস্ট করেছেন যে, বিস্তারিত আমি জানি না, উনারা একটা আইন করবেন। ফাইনালি বলেছেন এটা একটা স্বাধীন কর্তৃপক্ষ হবে। ইলেকশন কমিশন ইটসেলফ ইজ স্বাধীন। আমরাই তো স্বাধীন। আমাদের মধ্যে আরেকটা স্বাধীন দিলে তো আরেকটা মুশকিল।“

ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম স্বাধীন করার সুপারিশ নিয়েও আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, “ভোটার এনআইডি কার্ড, ভোটার রেজিস্ট্রেশন, পরবর্তী পর্যায়ে আবার স্বাধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তরে হ্যান্ডওভার করার জন্য সাজেস্ট করছেন। আমি ভোটার লিস্ট করব, আর অন্য এক কর্তৃপক্ষ এটার দায়িত্বে থাকবে! তাহলে ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকবে?”

নির্বাচন সংস্কারের প্রতিবেদন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা।

বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে এই দুটি সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

সংসদীয় কমিটি দিয়ে তদন্তের বিষয়ে সিইসি বলেন, “মেয়াদের পরে আমি যখন থাকব না, পাঁচ বছর পরে আমার পেছনে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির লোকজন তদন্ত করে প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ দেবে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য!

“কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমরাও আইনের ঊর্ধ্বে নই। যখন আমরা থাকব না, বিচার করার জন্য যথেষ্ট আইন আছে। এখন পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিকে যদি এ দায়িত্ব দেওয়া হয়… এখন ধরেন স্থানীয় নির্বাচনে কোনো সংসদ সদস্য, পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটি আমাকে অনুরোধ করল ভোটকেন্দ্র বাড়ির পাশে আনেন, আমি মানলাম না। উনি বলবেন, আচ্ছা দাঁড়াও চার বছর যাক, পার হোক, তখন দেখা যাবে। এটা হবে।”

“সুতরাং পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে গেলে আমাদের স্বাধীনতা খর্ব হবে, স্বাধীনতা কম্প্রমাইজড হবে। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব না। এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না,” বলেন তিনি।

সিইসি নাসির বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেমনভাবে পার্লামেন্টারি ইলেকশন হবে, কেয়ার গর্ভমেন্ট না থাকলেও লোকাল গভার্নমেন্ট ইলেকশনটাও কোয়ালিটি ইলেকশন হবে যদি ইসির স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকে। সুন্দর ইলেকশন হবে।”

ভোটের কতদূর

সংস্কার নিয়ে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির স্পষ্ট দূরত্ব দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলছেন নির্বাচনের কথা; অন্যদিকে সরকার বলছে সংস্কারের কথা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অন্তর্বর্তী সংস্কার যত সংস্কারে হাত দিয়েছে, তা ১০ বছরেও শেষ হবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ম্যান্ডেট রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন করে আসছেন বিএনপির নেতারা। তারা সেজন্য দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলেছেন।

মির্জা ফখরুলও বলেছেন, ন্যূনতম সংস্কারের পর নির্বাচন দিয়ে সংস্কারের বাকি কাজ সারার ভার নির্বাচিত সরকারের হাতে দেওয়া দরকার। কেননা যে কোনো সংস্কার তো নির্বাচিত সংসদেই পাস করাতে হবে।

নির্বাচনী কোনো রোডম্যাপ এখনও ঘোষণা করেনি সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস শুধু দুটি সময়ের কথা বলছেন। একটি এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে, আরেকটি আগামী বছরের মাঝামাঝিতে।

সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বৈঠকেও ইউনূস বলেন, “দেশের মানুষ কোন ধরনের নির্বাচন চায়, সেটি না জেনে সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না।

“জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নির্বাচনের প্রক্রিয়া কেমন হবে। তারা কি ছোট পরিসরের সংস্কার কর্মসূচিতে যাবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চাইবে। যদি মানুষ দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।”

ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চাইলে তার অন্তত দুমাস আগে তফসিল ঘোষণা করতে হবে, মনে করিয়ে দিলেন সিইসি নাসির।

তিনি বলেন, “তার মানে টু প্রিপেয়ার মাইসেলফ, অক্টোবর পর্যন্ত সময় পাচ্ছি। আমাকে যা কিছু করতে হবে, ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে গেলে আমাকে অক্টোবরের মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে হবে।”

নিজেদের অবস্থা তুলে ধরে সাংবিধানিক এই সংস্থার প্রধান বলেন, “সব কিছু রেডি নেই। আমাদের জন্য মাঠটা রেডি নেই, নির্বাচনের আইন-কানুন, বিধি-বিধান চূড়ান্ত অবস্থায় নেই।

“সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, আমরা এখনও নিশ্চিত নই।”

ভোটার নিবন্ধনের কাজটিও যে সময়সাপেক্ষ, তাও তুলে ধরেন সিইসি। তিনি বলেন, “কাজটা শুরু করে দেওয়া হয়েছে, টাইমটাকে এগিয়ে আনা হয়েছে। বড় কাজ হচ্ছে সীমানা পুনর্নির্ধারণ। এ নিয়ে দেড়শ আবেদন এসেছে। এসব নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।”

দল নিবন্ধনের কাজটি হালনাগাদের কথাও বলেন তিনি।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরে না হলে পরবর্তী জুন মাসের যে কথা বলেছেন, বর্ষার কারণে সেই সময়টাও বাংলাদেশে ভোটের উপযোগী মৌসুম নয় বলে মনে করিয়ে দেন সিইসি।

এর মধ্যে আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এক বক্তৃতার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, “গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত হওয়া সরকারের ম্যান্ডেট ষাট-সত্তরভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়া রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি।”

সংস্কারের ম্যান্ডেট নিয়ে ফখরুলের প্রশ্ন তোলার প্রতিক্রিয়ায় একথা বলার পাশাপাশি হাসনাত বলতে চেয়েছেন, এখন দেশ সংস্কারের কাজই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ্।

প্রধান উপদেষ্টা ও সরকার পতন আন্দোলনের ছাত্রনেতারা সংস্কারে গুরুত্ব দেওয়ায় দৃশ্যত তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে নির্বাচন। ফলে ভোট ক্রমেই সরে যাচ্ছে দূরে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads