নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন প্রবাসীরা, ‘জঙ্গিবাদ’ নিয়ে ভয়

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুরের সময় এভাবে ওড়ানো হয় নিজেদের পতাকা।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুরের সময় এভাবে ওড়ানো হয় নিজেদের পতাকা।

গত দুইদিনে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় ভেঙে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, স্থাপনা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আগুনে পুড়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাড়িঘর।

এসব দেখে প্রবাসীদের কেউ কেউ বলেছেন তারা লজ্জিত, ক্ষুব্ধ; কেউ বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি আজীবন ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ের দগদগে ঘা হয়ে থাকবে। আবার কেউ বলেছেন, বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি লজ্জিত। প্রতিরোধের কথাও এসেছে কারও কারও জবানিতে। কেউ আবার সংশয় প্রকাশ করেছেন জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে।  

ঘটনার শুরু ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে হলেও কার্যত অন্তর্বর্তী সরকারের নিস্পৃহতা, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দর্শকের ভূমিকা কথিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ও ইসলামপন্থিদের আশকারা দিয়েছে বলে মনে করছেন প্রবাসীদের অনেকেই।

দ্য সান ২৪ ফোনে কথা বলেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে।  

ঘটনা সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তহুরা আহমেদ চৌধুরী যেমন বলছিলেন, “আমি একজন আমেরিকা প্রবাসী। কিন্তু আমি যে পোড়া দেশে জন্মেছি সেই দেশ এখন জল্লাদের উল্লাস ভূমিতে পরিণত হয়েছে। একাত্তরে যেমন মানুষের বাড়িঘর নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসররা, সেই পরাজিত শক্তিরা মনে হয় আরও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে।”

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আঘাত করার সাহস পাকিস্তানিরাও দেখাননি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানিরা সারা বাংলাদেশকে শ্মশান বানিয়ে দিলেও বত্রিশ নম্বরে হাত দেওয়ার সাহস করেনি, যা  চুয়ান্ন বছর পর আমার দেশেরই কিছু অমানুষ, যাদের দেহ বাংলাদেশে আর আত্মা পাকিস্তানের কাছে বন্ধক রাখা আছে, সেই জঙ্গিরা বাঙালির তীর্থস্থানকে ধ্বংস করে দিল।”

পাকিস্তানিরা সারা বাংলাদেশকে শ্মশান বানিয়ে দিলেও বত্রিশ নম্বরে হাত দেওয়ার সাহস করেনি, যা  চুয়ান্ন বছর পর আমার দেশেরই কিছু অমানুষ, যাদের দেহ বাংলাদেশে আর আত্মা পাকিস্তানের কাছে বন্ধক রাখা আছে, সেই জঙ্গিরা বাঙালির তীর্থস্থানকে ধ্বংস করে দিল — তহুরা আহমেদ চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র

প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সময় এসেছে আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকেই এদেরকে প্রতিরোধে যা যা করা প্রয়োজন সব করতে হবে। না হলে আমরা আবার খুব শীঘ্রই পাকিস্তানের গোলামে পরিণত হব।

মন্তব্যের শেষে তিনি এটিও মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তানিরা যদি ফুল নিয়ে আসে তবুও আমরা তাদেরকে কে বিশ্বাস করব না।

ফিনল্যান্ড প্রবাসী ও ফিনল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ডেইলি ফিনল্যান্ডের সম্পাদক ওফিউল হাসনাত রুহিন অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, “যারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা আবার অন্যকে বলে ফ্যাসিস্ট!”

যারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা আবার অন্যকে বলে ফ্যাসিস্ট! — ওফিউল হাসনাত রুহিন, ফিনল্যান্ড

বাংলাদেশের ইতিহাসের আঁতুড়ঘর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের জন্য কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।

সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে শফিকুর রহমান বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের বছরই আমার জন্ম। ডিসেম্বরে। সে অর্থে মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি, কিন্তু গন্ধটা অনুভব করতে পারি। দেশে গেলেই ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি গিয়ে দেখে আসতাম। আজ জঙ্গিরা সব শেষ করে দিল।”

এ ঘটনাকে কেবল আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ থেকে ঘটানো হয়েছে তা মানতে নারাজ এই ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, “এটি পরিকল্পিত, এবং সরকারের মদদে সংঘটিত একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। যেখানে ইউনূস থেকে শুরু করে পাকিস্তানের জড়িত থাকার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। মনে রাখবেন, কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছে, এবং এর কয়েক দিনের মাথায় বাংলাদেশে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হলো।”

এটি পরিকল্পিত, এবং সরকারের মদদে সংঘটিত একটি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। মনে রাখবেন, কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছে, এবং এর কয়েক দিনের মাথায় বাংলাদেশে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হলো — শফিকুর রহমান, সৌদি আরব

যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

পোল্যান্ডের স্থায়ী অভিবাসী ও নাগরিক এহসান মুত্তালিব ইমন যেমন বললেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী আদর্শ ধারণ করেন না। তবে তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।

“একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে এ ঘটনা আমাকে ব্যথিত করেছে। মেনে নিতে পারছি না, আমাদের দেশে এভাবে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এর দায় ইউনূসকে নিতে হবে। এবং সুদে আসলে পরিশোধও করতে হবে।”

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে এ ঘটনা আমাকে ব্যথিত করেছে। মেনে নিতে পারছি না, আমাদের দেশে এভাবে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এর দায় ইউনূসকে নিতে হবে। এবং সুদে আসলে পরিশোধও করতে হবে — এহসান মুত্তালিব ইমন, পোল্যান্ড

সাইপ্রাসের স্থায়ী বাসিন্দা রুবেল মোহাম্মদ জানান, গত দু’দিন ধরে তিনি ঘর থেকেই বের হতে পারছেন না।

“নিজেকে অসভ্য, বর্বর মনে হচ্ছে। যে জাতি তার পিতার বাড়ি পুড়ে দিতে পারে সে জাতি কতোটা বর্বর, কতোটা অসভ্য তা ভেবে আমি লজ্জিত। সময়ের সঙ্গেও এই ক্ষত পূর্ণ হবার নয়।”

“বিদেশ থেকে কষ্টের রেমিটেন্স এই অসভ্য ও বর্বরদের পেছনে কেন ব্যয় করবো?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

বিদেশ থেকে কষ্টের রেমিটেন্স এই অসভ্য ও বর্বরদের পেছনে কেন ব্যয় করবো? — রুবেল মোহাম্মদ, সাইপ্রাস

ব্যারিস্টার প্রতীক রহমান, যিনি বর্তমানে ফিনল্যান্ডের রোভানিয়েমিতে থাকছেন, বলেন, বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছি। দেশে থাকলে অপরাধবোধটা হয়তো কয়েক গুণ বেশি হতো। ৩২ নম্বরের বাড়িটা ইট বালু সিমেন্টের একটি বিল্ডিং নয়, এটা ৬৬ সনের ছয় দফার সাক্ষী, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সাক্ষী, ৭০ এর নির্বাচনের সাক্ষী।”

তিনি বলেন, “দেশে থাকলে ভীতুর মত ঘরে লুকিয়ে থাকার অপরাধবোধে মারা যেতাম, আর না হয় স্বাধীনতার এই প্রতীককে বাঁচাতে গিয়ে মারা পড়তাম।”

আওয়ামী নেতাদের বাড়ি ভাঙা পর্যন্ত এদের সাথে ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকে হাত গেলে তাদের সাথে নাই — প্রতীক রহমান, ফিনল্যান্ড

কিছুদিন আগেও বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে সোচ্চার থাকা প্রতীক আরও বলেন, “আওয়ামী নেতাদের বাড়ি ভাঙা পর্যন্ত এদের সাথে ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকে হাত গেলে তাদের সাথে নাই।”

নিজের হতাশা ও ক্ষোভের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আরিফ চৌধুরী বলেন, আমি নির্বাক, স্তম্ভিত, লজ্জিত। আমরা জাতি হিসেবে এতটা নিচে নেমে গিয়েছি, আমাদের এতটা অধঃপতন হয়েছে তা দীর্ঘ দিন প্রবাসে কাটিয়ে বুঝতে পারিনি। এই কি আমাদের এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল?”

আমি নির্বাক, স্তম্ভিত, লজ্জিত। আমরা জাতি হিসেবে এতটা নিচে নেমে গিয়েছি, আমাদের এতটা অধঃপতন হয়েছে তা দীর্ঘ দিন প্রবাসে কাটিয়ে বুঝতে পারিনি — আরিফ চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “আমি ‘৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছিলাম, তখন আমারা সবাই এই দেশের মানুষ হিসেবে লড়েছি, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য বিরোধ, মারামারি হলেও বিবেক, বুদ্ধি ও সীমারেখা ছিল। আমাদের মধ্যে স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ব্যাপারে বিরোধ ছিল না।”

যারা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তাদের বাংলাদেশি মানতে নারাজ এই মার্কিন নাগরিক।

তিনি বলেন, “এদের দেখে মনে হচ্ছে ওরা আমাদের দেশের মানুষ না, আমাদের বিশ্বাসের সাথে গাদ্দারি করে অন‍্য করো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছে।

“এদেশ থেকে চিরতরে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্প্রীতি ও জাতিসত্তা ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের দেশকে ইরাক, সিরিয়া লিবিয়া বানানোর চেষ্টা করছে। আমরা সবাই এখনই তাদের ব‍্যপারে সাবধান হতে হবে। সময় ক্ষেপণ না করে দেশের সবাইকে বুঝাতে হবে যে এরা আমাদের কোনও ক্ষতি করতে আবির্ভূত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরেক প্রবাসী মাসুদ হাসান তূর্ণ তার জবানিতে ঘটনার সঙ্গে সরকারের ভূমিকা কতোটা নিবিড় সে প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে সরকার আছে কিনা এবং তার কোন অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি। কারণ একটি সরকার থাকলে অথবা যে দেশে বর্তমানে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে তারা থাকতে কী করে একদল সন্ত্রাসী মানুষের ঘরবাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে,মানুষের জানমাল ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং এইগুলো ঘটনা হচ্ছে কোন ধরনের কোন পদক্ষেপ সরকারের পক্ষে নিয়েছে তা চোখে পড়ছে না?

বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে এমন সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে তূর্ণর মনে।

তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে এবং বাংলাদেশের যে অস্তিত্ব, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি চিরতরে মুছে ফেলার জন্য মৌলবাদী শক্তি উঠেপড়ে লেগেছে।”

আমার কাছে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে এবং বাংলাদেশের যে অস্তিত্ব, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি চিরতরে মুছে ফেলার জন্য মৌলবাদী শক্তি উঠেপড়ে লেগেছে — মাসুদ হাসান তূর্ণ, যুক্তরাষ্ট্র

“মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হতো আজকে আমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে আসতে পারতাম না। টাকা ইনকাম করে বাংলাদেশে পাঠাতে পারতাম না। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যারা অস্বীকার করে তাদের বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা আছে বলে আমি মনে করি না।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে সারা বিশ্বের বুকে পরিচিত করানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

“আমি মনে করি অচিরেই সব মব ভায়োলেন্স বন্ধ করে সকলের জন্য ন‍্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

আরও পড়ুন