গত দেড় দশকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় মার্কেট কিংবা বাস টার্মিনাল- চাঁদাবাজি ছিল সর্বত্র। এই চাঁদাবাজির একটি অংশ পুলিশের পকেটেও ঢুকত বলে ছিল অভিযোগ।
অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতা-কর্মীরা রাজনীতির মাঠে এখনও ফিরতে পারেনি। জনরোষে পড়া পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আগের দাপট ফিরে পায়নি।
তাহলে কি চাঁদাবাজি এখন বন্ধ? উত্তর খুঁজতে গিয়েছিল বিবিসি বাংলা। তাতে দেখা যাচ্ছে, পুরনো চাঁদাবাজরা সরে গেলেও গজিয়েছে নতুন চাঁদাবাজ।
কারা এই চাঁদাবাজ? সেই প্রশ্নের উত্তর বিএনপির পদক্ষেপেই পাওয়া যায়। গত আট মাসে তারা দেড় হাজারের নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে দলটি। চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হয় বিএনপিকে।
বিএনপি এখন ক্ষমতায় না এলেও দলটির নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার বিষয়টি জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তুলে আসছেন।
তবে জামায়াতও মুক্ত নেই। তাদের নেতাদের বিরুদ্ধেও কয়েকটি স্থানে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধেও।
চাঁদাবাজি এখন কেমন?
আওয়ামী লীগ আমল ও এখনকার চাঁদাবাজির ধরনের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আগে চাঁদা দিতে হতো একজনরে, এখন দিতে হইতেছে চার-পাঁচজনরে। এখন তো আননোন (অপরিচিত) নম্বর থেকে ফোন আসলেই ভয় লাগে। আবার কে জানি টাকা চায়!”
আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকার পরও মামলার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ওই ব্যবসায়ী। যারা চাঁদা নিয়েছেন, তারা বিএনপির বলেই তার অভিযোগ।
পথে পথে চাঁদাবাজিও থেমে নেই বলে জানান যশোর থেকে সবজিভর্তি ট্রাক নিয়ে ঢাকায় আসা ট্রাকচালক সেলিম হোসেন। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতে পথে তাকে চারটি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
সেলিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যশোর থেকে নড়াইলে ঢুকার পর একবার চাঁন্দা দিতি হয়। এরপর গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, তারপর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ঢুকে ৪০ টাকা, ৫০ টাকা করে চাঁন্দা দিয়া লাগে।”
এরপর সবজি নিয়ে কারওয়ান বাজারে গিয়ে গাড়ি রাখার জন্য এই চালককে দিতে হয় আরও ২০০ টাকা।
সেলিম বলেন, “কত কিছু বদলাচ্ছে শুনতিছি। কই চাঁন্দাবাজি তো বন্ধ হয়নি! আমরা তো দেখতিছি, খালি কাপড় বদলাইছে।”
উত্তরবঙ্গ থকে ট্রাকে সবজি নিয়ে আসা আরেক চালক মোহাম্মদ সম্রাটও একই অভিযোগ তুলে বলেন, “আগে নিত আওয়ামী লীগ, এখন নেয় বিএনপি। টাকার মাফ নাই।”
তবে মহাসড়কে এখন পুলিশকে চাঁদা দিতে হচ্ছে না বলে জানান চালকরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কিছুদিন কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। তবে এখন আবার আগের মতোই বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
এক ব্যবসায়ী বলেন, “তখন ছাত্রগো ভয়ে কেউ সাহস পাইতো না। কিন্তু কিছুদিন যায়তে না যায়তেই আবার সব আগের মতো।”
“কেউ আইয়া কয় যুবদল, কেউ ছাত্রদল। আরও আছে শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল। একেক সময় একেক গ্রুপ আহে। কয়জনরে টাকা দিমু? ওগো জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ,” বিবিসি বাংলাকে বলেন এক আড়তদার।
গুলিস্তান মোড় এবং এর আশপাশের সড়কের ফুটপাত দখল করে থাকা হকারদের আগের মতোই চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এক হকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “টাকা ছাড়া কেউ এখানে বসতে পারে? আওয়ামী লীগ আমলে যা দেয়া লাগতো, এখনও তাই দেয়া লাগে।”
একেকজন হকারকে ১ লাখ টাকা দিয়ে বসতে হয় বলে জানান হকাররা। একজন বলেন, “আমার ধারে মাসে ৯ হাজার টাকা ভাড়া চাইছে। আমি দেতে পারি নাই, পরে আমারে মারধর কইরা দোকান তুইলা দিছে।”
হকারদেরও অভিযোগও বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। তারা বলেন, আগে আওয়ামী লীগ নেতারা চাঁদা নিত, এখন বিএনপি নেতারা নিচ্ছেন।
বিএনপির বাইরে গত কয়েক মাসে ফেনীতে জামায়াতে ইসলামীর জেলা পর্যায়ের এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে রংপুরে নাহিদ হাসান খন্দকার নামে এক নেতার চাঁদা দাবির ভিডিও এবং অডিও সোশাল মিডিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল।
পরিবহনে চাঁদাবাজিও আগের মতোই চলছে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে এই চাঁদা আগে নেওয়া হত, এখনও নেওয়া হয়। শুধু সংগঠনগুলোর নেতা বদলে গেছে।
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি বাসকে চাঁদা দিতে হয় ৫২০ টাকা। প্রকাশ্যেই নেওয়া হয় সেই চাঁদা।
চাঁদা আদায়কারী একজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এইডাই এখানকার সিস্টেম। গাড়ি ছাড়ার আগে এই টাকা দিতে হয়। মালিক সমিতির নির্দেশেই এইডা তোলা হয়।”
ঢাকা শহরে বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে দৈনিক গড়ে ২ কোটি টাকার ওপরে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
ঢাকায় বাস টার্মিনালে মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে মূলত চাঁদা নেওয়া হয়ে থাকে। সেগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, সভাপতি ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর তাদের দেখা আর মিলছে না। ইস্কাটনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ এখন বিএনপি নেতাদের হাতে। এখন সভাপতি হয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাজী আলাউদ্দিন। মহাসচিব হয়েছেন কুমিল্লা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। তিনি আবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। সেখানে সভাপতি হয়েছেন বিএনপি নেতা এম এ বাতেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে আগে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। সরকার পতনের পর গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এখন কারাগারে।
সংগঠনে এখন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছেন বিএনপির আব্দুর রহিম বক্স। সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর পদে বসেছেন বিএনপির আরেক নেতা হুমায়ুন কবির খান।
বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের নেতৃত্বও বদলে গেছে। আগে সভাপতি ছিলেন তালুকদার মোহাম্মদ মনির। সরকার পতনের পর হত্যা মামলার আসামি হয়ে তিনি এখন কারাগারে। সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম পাটোয়ারীও আত্মগোপনে।
এ অবস্থায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বশির হাওলাদার। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মোহাম্মদ আলমগীর। দুজনই বিএনপির।
তেজগাঁও এলাকার ট্রাক স্ট্যান্ডেও প্রতিটি গাড়ি থেকে ১৪০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এর ১০০ টাকা নিচ্ছে ট্রাক-কভার্ডভ্যান মালিক সমিতি। ২০ টাকা নিচ্ছে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। প্রহরীদের বেতন বাবদ নেওয়া হচ্ছে বাকি ২০ টাকা।
মহাখালীর পাশাপাশি গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালেও বাস ঢোকানো এবং বের করার সময় চাঁদা দিতে হয়।
বাস মালিকদের দুই সংগঠনের নেতাদের সম্মতিতেই চাঁদার হার নির্ধারণ হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
এর বাইরে, যেকোনো রুটে নতুন বাস নামানোর সময় মালিক সমিতিকে এককালীন মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। জেলা বা স্থানীয় মালিক সমিতিকেও দিতে হয় চাঁদা।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, কেবল ঢাকা শহরের অবস্থিত অর্ধশতাধিক পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।
অভিযোগ অস্বীকার
মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করছে। তারা দাবি করেছেন, চাঁদাবাজি ছিল আওয়ামী লীগ আমলে, এখন নেই।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বাতেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তখন সমিতির নামে চাঁদা উঠাইতো বিভিন্ন জায়গায়। আমরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।”
টার্মিনালগুলোতে প্রতি বাস থেকে এখন যে টাকা নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি বলেন, “সেটা চাঁদা না। সেটা হলো পরিচালনা ব্যয়। অফিস ভাড়া, বেতন, টিকেট, কর্মচারী ইত্যাদি খরচের জন্য কোম্পানিগুলো এটা তোলে। আওয়ামী লীগ আমলে যেখানে দেড়-দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হতো, আমরা এখন সেটা ৩০০-৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি।”
ট্রাক-কভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভপতি তোফায়েল হোসেন মজুমদারও বলেন, “ট্রাক স্ট্যান্ডের উন্নয়ন কাজে যে খরচ হয়েছে, সেটার জন্যই ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। বাকিটা সংগঠনের কাজে ও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।”
দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা এটা সহ্য করছেন না। যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠছে, খতিয়ে দেখে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থাও নিচ্ছি। মামলা করে আমরা অভিযুক্তদেরকে পুলিশের হাতে পর্যন্ত তুলে দিচ্ছি।”
বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকে গত সাত মাসে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা মেলায় ১২টিরও বেশি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
তবে পরিবহন খাতে দখলদারির অভিযোগ অস্বীকার করছেন বিএনপি নেতারা।
পরিবহণে চাঁদাবাজি আগের মতো চললেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করছে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বসেছি, পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। বিআরটিএও কঠোর হচ্ছে।”