২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি. শেখ হাসিনার টানা দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের দুই বছর পূর্ণ হলো। জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বললেন, বাংলাদেশে মিডিয়া এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে সরকারের সমালোচনা করতে পারছে।
তারপর বিভিন্ন সময়ই শেখ হাসিনা বলতেন, সাংবাদিকদের কোনো বাধা দিচ্ছে না তার সরকার। বরং নতুন নতুন টিভির লাইসেন্স দিয়ে এবং ইন্টারনেট অবারিত করে সরকারের সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোকে সামনে আনতেন তিনি; বলতেন, টকশোগুলোতে সরকারের সমালোচনায়ও কোনো বাধা সরকার দিচ্ছে না।
কিন্তু তখন সাংবাদিকরা ঠিকই জানতেন তার সেই কথার অসারতা। ভয়-ভীতির পাশাপাশি নানা আইনের বেড়াজাল থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করার দাবিতে রাজপথেও নামতে হয়েছে সাংবাদিকদের।
২০১৬ সালের পর দিন যত গড়িয়েছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ততই সঙ্কুচিত হয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে আর্টিকেল নাইনটিনের সূচকে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বে ১২৮তম স্থানে নেমে যায় বাংলাদেশ। স্কোর ছিল মাত্র ১২। যেখানে ২০০০ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৪।
তার দুই মাস পর যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো, তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি বড় হয়ে সামনে এসেছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে গ্রাফিতিগুলো এখনও তার সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে।
সেই অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা উঠে যাবে বলেই আশা দিচ্ছিল নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা।
সরকারর মাস পূর্তিতে গত ১২ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে।
“আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।”
শেখ হাসিনার কথা আর ইউনূসের কথায় কোনো ফারাক না থাকলেও ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ থেমে ছিল না।
তার কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে হয়েছে, কিছু অগোচরে থেকে গেছে। কিছু দিন আগে সরকার আপত্তি তোলার পর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে প্রকাশিত সংবাদ সরিয়ে নিতে দেখা যায়।
এবার সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার জেরে চাকরি হারাতে হলো তিনজন সাংবাদিককে। সেই সঙ্গে দীপ্ত টিভির সংবাদ সম্প্রচারই বন্ধ হয়ে গেল।
সেকাল আর একাল
আওয়ামী লীগের শাসনকালে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তাকে তোষণের সংবাদ সম্মেলন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লেখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ডাকা না ডাকা নিয়েও যে পছন্দ-অপছন্দ ছিল, তার আঁচ পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক সময়কার উপ প্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকনের এখনতার এক ফেইসবুক পোস্টে।
দুই সময়ের তুলনা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, কীভাবে তখন সাংবাদিক মুন্নি সাহা ও খালেদ মুহিউদ্দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
খোকনের ভাষ্যে, “আমি তখন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিবের দায়িত্বে। প্রধানমন্ত্রীর দুটি ভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে তারা দুজনই সাহসিকতার সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন—প্রশ্ন ছিল জবাবদিহিমূলক, কিছুটা তীক্ষ্ণও। প্রধানমন্ত্রীও উত্তর দিয়েছিলেন তার স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণতা ও দৃঢ়তায়।
“এই দুটি ঘটনার কিছুদিন পর ওহী নাজিল হলো- ওনাদের দুইজনকে সংবাদ সম্মেলনে যাতে আর আমন্ত্রণ জানানো না হয়। আমার প্রতিবাদ ধোপে টিকলো না। এমন একজন ব্যক্তি বললেন, তাকে ডিঙিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করা, ওনার পক্ষ থেকে এরকম কোনো নির্দেশনা সত্যি এসেছে কিনা – সেটা যাচাই করার সাহস আমার হয়নি।”
তবে তখনও সোশাল মিডিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রচার কিংবা তাদের চাকরিচ্যুত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন খোকন।
এদিকে উপদেষ্টা ফারুকীকে প্রশ্ন করার পর তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যাপক চাপ তৈরি করা হয় ফেইসবুকের ‘জুলাই রেভ্যুলেশনারী অ্যালায়েন্স-জেআরএ’ পাতা থেকে।
অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিদেশে থাকা যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক দিলশানা পারুল তো হুমকি দিতেও কুণ্ঠিত হননি।
তিনি ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “বাংলাদেশের দালাল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, হাসিনার দালালি করতে হলে সাবধানে করতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে সরকারি হিসাবে চৌদ্দশ প্রাইভেট হিসাবে 2000, হাসিনাকে দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটনার পিছনে এই সমস্ত দালাল সাংবাদিকরা সম্পূর্ণভাবে দায়ী।
“আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই সমস্ত খুনের মদদকারী সাংবাদিকদের আমরা বিচারের আওতায় আনতে পারি নাই। খোদার কসম শুধু চাকরি হারিয়ে ভাতে মরবে, এই সমস্ত দালালরা সেইটা হবে না। খুনির মদদদাতা হিসেবে এই সমস্ত সাংবাদিকদের চেহারা ভাইরাল করেন। যদি আর কিছু আমরা না পারি, রাস্তায় যেন এদের গায়ে থুতু ছিটানো হয়, সেই বিচারের ব্যবস্থাটুকু আমরা করতে পারি।”
“জুলাইয়ের পরে দালালি করতে হইলে আরো সাবধানে করেন। এটা যদি থ্রেট মনে করতে চান, এটা থ্রেট.” সাংবাদিকদের উদ্দেশে লিখেছেন তিনি।
তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি এবং দীপ্ত টিভির সংবাদ প্রচার বন্ধের ক্ষেত্রে নানা হুমকি কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করলেও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে তাদের কোনো হাত নেই।
আওয়ামী লীগের শাসনামলেও একই ধরনের কথাই বলা হতো। ২০১৮ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইট বন্ধের নির্দেশ দিলেও শেখ হাসিনার সরকারা তখন তা স্বীকার করেনি। গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলেও তা স্বীকার করেনি সরকার।
এবার তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রেও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেও একই রকম বক্তব্যই এসেছে।
সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুকী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আজকে (মঙ্গলবার) সারাদিন আমি বিশ্রামে ছিলাম। আপনার কাছেই প্রথম এটা জানলাম। আমি বা আমার মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে একদমই ওয়াকেবহাল না। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোই আসলে বলতে পারবে, তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ কী?”
মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তথ্য উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমও বলেন, সরকার দীপ্ত টিভির সংবাদ কার্যক্রম বন্ধ করেনি। এটি দীপ্ত টিভি কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত।
তবে এটিএন বাংলা ও দীপ্ত টিভির কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে তাদের রিপোর্টারের প্রশ্নের জেরে টিভি চ্যানেল ঘেরাওয়ের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
চাপ যারা দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাদেরই ‘নিয়োগকর্তা’ বলেছিলেন ইউনূস।
যারা আট মাস আগেও শেখ হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, তখন সাংবাদিকদের ভূমিকা দেখে ‘বাতাবিলেবু সাংবাদিকতা’ বলতেন, তাদের উল্টোরথ দেখে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ফেইসবুকে একটি ছড়া লিখেছেন। ‘জুলাই দিয়ে ঝুলাই!’ শিরোনামের ছড়াটিতে তিনি লিখেছেন-
“০১
প্রশ্ন করা বাজে অভ্যাস
প্রশ্ন করা বাজে,
প্রশ্নকর্তা চিরকালই
ব্যাঘাত ঘটায় কাজে।
মিট দ্য প্রেসে দৌড়ে এসে
ভাষণ দেয়ার মাঝে–
ও সাংবাদিক তোমার কি ভাই
প্রশ্ন করা সাজে?
মার্চ ডিসেম্বর মুইছা দিসি
আমরা অখন জুলাই,
মিট্টিকুলাস পদ্ধতিতে
জুলাই দিয়ে ভুলাই।
পুরান দোকান বন্ধ করাই
নতুন দোকান খুলাই,
বাড়াবাড়ি করলে কেহ
জুলাই দিয়েই ঝুলাই।
০২
সাংবাদিক তো কী হয়েছে?
প্রশ্ন করবি ক্যান?
কাল থেকে তোর টিভির নিউজ
প্রচার করা ‘ব্যান’।
ন্যান জুলাইয়ের স্বাধীনতা
পকেট ভইরা ন্যান!”
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
‘আমরা ষড়যন্ত্রে নেই’- চাকরিচ্যুতি ও দীপ্ত কাণ্ডে ফারুকী-মাহফুজের সাফাই
উপদেষ্টা ফারুকীর ‘কোপে’ চাকরি খোয়ালেন তিন সাংবাদিক, বন্ধ দীপ্ত’র সংবাদ