ইউনূস সরকারের নিন্দাও এখন হচ্ছে নিন্দিত

ফাইল ফটো।
ফাইল ফটো।

গত ২৯ আগস্ট জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষের সময় নুরুল হক নুরের পর সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলার পর ‘কড়া’ নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি বাহিনীই যখন হামলাকারী, তখন সেই বিবৃতি বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।

শুক্রবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার মাজারে মব তৈরি করে হামলার ঘটনায় যখন উঠেছে সমালোচনা, তখন আবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ফেইসবুক পাতায় বিবৃতি এল, এবারও কড়া ভাষায় নিন্দা।

এটা প্রথম নয়, গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে যে কোনো ঘটনায় এমন নিন্দা করতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন মাজারে একের পর এক হামলা, মেয়েদের ফুটবল খেলতে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনায়ও নিন্দা জানিয়েই দায় সেরেছে সরকার। কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, সরকারের কাজ কি নিন্দা জানানো, না কি এমন ঘটনা ঠেকানো?

কিন্তু সেই একই ধারা চলতে দেখে এখন বলা হচ্ছে, সরকার এখন নিন্দা জানানোর একটি মন্ত্রণলায় খুললেই পারে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে মব সন্ত্রাস চলছে বাংলাদেশে; তার মধ্যে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ছত্রছায়ায় ‘তৌহিদী জনতা’ নামে একের পর এক মাজার ভাঙা চলে। দুইশটি মাজার কয়েক মাসের মধ্যেই ভাঙা হয়।

গত শুক্রবার গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার সাজারে হামলা হয় ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে। ভাংচুরে পাশাপাশি কবর থেকে লাশ তুলেও আঘাত করার মতো ঘটনা ঘটে। ওই দিন রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি খানকা শরিফেও মব তৈরি করে পুলিশের সামনেই ভাংচুর চালানো হয়।

কেবল মাজারে হামলা নয় সম্প্রতি মব সন্ত্রাসের আরো কয়েকটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ২৮ অগাস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ এর আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে মব সৃষ্টি করে আলোচকদের হেনস্তা করে অনুষ্ঠান পণ্ড করে একদল ব্যক্তি। কিন্তু হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং হামলার শিকার ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এর আগে গত অগাস্টে রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লাল নামে দুই ব্যক্তিকে মব তৈরি করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।

একই জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি গ্রামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চলে গত ২৬ ও ২৭ জুলাই।

একের পর এক ঘটনা ঘটে চললেও সরকারের তৎপরতা শুধু বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখে ব্যঙ্গ করে ‘বিবৃতিতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ বলে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন নেত্র িনউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল। 

তিনি লিখেছেন, “নিন্দা প্রকাশ করে আর একটি বিবৃতি আসার আগে এই সময়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের ঘোষণা সম্বলিত সরকারের বিবৃতিটিই কেবল গ্রহণযোগ্য হতে পারে।”

অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের লিখেছেন, “নিন্দা ও হুঁশিয়ারি প্রদানের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা যেতে পারে, যার একমাত্র কাজ হবে প্রতিটি ঘটনা ঘটতে দেয়া এবং ঘটার পর নিন্দা জানানো এবং হুঁশিয়ারি দেওয়া।”

তিনি আরও বলেন, “অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই বিশেষ মন্ত্রণালয়কে “মব” বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করার কাজও দেয়া যেতে পারে করা। জুলাই ডিক্লারেশনে এই মব’কে “পিপলস জাস্টিস” হিসেবে ব্যাখ্যা করে কোন ছুতোয় ঢুকিয়ে দেয়ার উপায় বের করা হবে এদের অন্যতম কাজ। পাশাপাশি, এই পিপলস জাস্টিসকে ফেসিলিটেড করার জন্য সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্যে একটি কমিশনও গঠন করা যেতে পারে, যাদের কাজ হবে বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিত করা ও সেসব ধ্বংস করতে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক কিংবা স্থানীয় সরকারের প্রকৌশল বিভাগের বুলডোজারের ব্যবহার সমন্বয় করা।”

একের পর এক অঘটনে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর এখন অনেকে। গত বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থার গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষা ও ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বদৌলতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।”

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এতে সরকারের দায়ের বিষয়টি তুলে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক, যে উদ্দেশ্যেই হোক, মব সন্ত্রাস করে একবার ছাড় পেলে সেই সুযোগ বারবারই নেয়ার শঙ্কা থাকে, আর বাংলাদেশে এখন সেটিই হচ্ছে।”

পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা এনিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কিছু ঘটনা ঘটবে, কিন্তু সরকারের উচিৎ আরও কঠোর হওয়া। তা না হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হবে।”

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নোবেলজয়ী ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতার দিকটি এখন বিদেশিদের চোখেও ধরা পড়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভালেরিয়াঁ ঢাকায় এসে গত শুক্রবার এক মতবিনিময় সভায় বলেন, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের কর্মীদের হয়রানি ও হুমকি এবং সহিংস পরিবেশে বাংলাদেশে সংস্কার টিকতে পারবে না।

আরও পড়ুন