এনসিপির দম কি ফুরিয়ে এল?

এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এরকম প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বহু তরুণ-তরুণী।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এরকম প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বহু তরুণ-তরুণী।

বছরের শুরুতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এক তরুণ, যাতে লেখা ছিল- ‘ছাত্র জনতা ঐক্য করো, অন্যায় অবিচার বিদায় করো’। গত কয় মাসের ব্যবধানে সেই স্লোগানে কতজন নতুন করে উজ্জীবিত হলেন, কিংবা তাদের মিছিল কতোটা দীর্ঘ হলো তা নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।

অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা কেউ স্বীকার না করলেও দৃশ্যমান। একদিকে সরকারি বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে দলটির শীর্ষ নেতারা চষে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, অন্যদিকে তাদেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নামও জড়িয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বদলি ও মামলা বাণিজ্য, শিশুদের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর মতো স্পর্শকাতর কাজে অর্থ কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মে।

এমনকি রাষ্ট্র নিয়ে ‘ষড়যন্ত্রে’ জড়িয়ে যাচ্ছে দলটির নাম, শীর্ষ নেতাদের কর্মকাণ্ড। সর্বশেষ জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের দিনে দলের পাঁচ শীর্ষ নেতার গোপনে কক্সবাজার ভ্রমণ নিয়েও জনমনে তৈরি হয়েছে সন্দেহ।

‘কক্সবাজার স্ক্যান্ডাল’ নিয়ে নানামত এবং এর নানামুখী প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় স্পষ্ট, ঘটনা যাই ঘটুক, সাধারণ মানুষজন যে বিশ্বাসের আসনে শেখ হাসিনার সরকারকে পতনের আন্দোলনের নায়কদের বসিয়েছিলেন সে অবস্থানে তারা আর নেই।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ‘আনুকূল্য পেয়েও’ নানা অনিয়মে জড়িয়ে যাওয়ার খবরের মাঝে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, থানা থেকে শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ হয়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যায়ের একের পর এক নেতার পদত্যাগের ঘোষণা দলটিকে ঠেলে দিচ্ছে আরও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে।

এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

গত ছয় মাসে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকডজন নেতা পদত্যাগ করেছেন। এরমধ্যে চলতি মাসে চট্টগ্রাম, সিলেট, মাদারীপুর; জুলাই মাসে ঢাকা, ফেণী, কুড়িগ্রাম, শরীয়তপুর; জুন মাসে রাজশাহী; মে মাসে চাঁদপুর, শরীয়তপুর; এমনকি আত্মপ্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পদত্যাগের ঘটনাগুলোর পেছনে দলীয় কোন্দল, অসন্তোষ কিংবা না জানিয়ে কমিটিতে রাখার মতো কারণ সামনে এসেছে।

কেউ কেউ পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যক্তিগত দর্শনের সঙ্গে দলীয় নীতির ফারাকের কথা। কেউ আবার নিজেকে দলের জন্য প্রয়োজনীয় অংশ ভাবতে না পারার মতো অসন্তুষ্টির কথাও তুলে ধরেছেন পদত্যাগ পত্রে। অনেকের অসন্তোষের কারণ গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি।

প্রশ্ন ওঠেছে- তাহলে কি ছয় মাসেই দম ফুরিয়ে এলো ‘বৈষম্য বিলোপের’ ইশতেহার নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করা তরুণদের? তাহলে কি যে আশায় তরুণরা ভিড়েছিলেন, তাদের স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে?

শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনকালের অবসান ঘটানোয় নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল হবে না, শুরুতে এমন ঘোষণাই এসেছিল প্ল্যাটফর্মটির নেতাদের কাছ থেকে। কিন্তু এই আন্দোলনের তরুণ নেতারা অভ্যুত্থানের পরের মাসেই ৮ সেপ্টেম্বর গঠন করেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। পরবর্তীতে ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে তারা দল গঠনের পথে এগোন, যা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিকক দলের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছিল সেসময়।

আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের বিরতিতে নামাজ আদায়ের দৃশ্য।

দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর পর একে কিংস পার্টি গঠনের প্রয়াস হিসাবে দেখার কথা বলেছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আর তা যে দেশের মানুষ ভালো চোখে নেবে না, সেই সতর্কবার্তাও দেন তিনি।

অবশ্য জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেননি। “আমরা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছি না”- একথা বলার পাশাপাশি তিনি বিএনপির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে প্রথম কিংস পার্টি গঠন করেছেন জিয়াউর রহমান। বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি।”

এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ ফেব্রুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কিংস পার্টির তকমা নিজে রাজি না হলেও সরকারি বাহিনীর বেষ্টনিতে নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি পালনের কারণে এরইমধ্যে এনসিপিকে আর দশটা কিংস পার্টির মতোই দেখতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষজনও।

তবে দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে একের পর এক পদত্যাগের ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়েছে। সর্বশেষ ৯ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন উপজেলা শাখার যুগ্ম সমন্বয়ক আরফান উদ্দিন মাসুদ ওরফে এ ইউ মাসুদ।

তিনি কমিটি গঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ‘মানা হয়নি’ অভিযোগ করে পদত্যাগ করেন।

পদত্যাগপত্রে তিনি দাবি করেন, এক ব্যক্তির ‘একক’ সিদ্ধান্তে, কোনো ধরনের আলোচনা বা পরামর্শ ‘ছাড়া’ এই ক‌মিটি গঠন করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ‘পরিপন্থি’।

দু’দিন আগে সিলেটে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ওই জেলায় গণ-অভ্যুত্থানে নিহত সাংবাদিক তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান জাবুর, যিনি সিলেট জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ছিলেন।

পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগের কথা উল্লেখ করলেও দ্য সান ২৪ এর কাছে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ব্যক্তিগত অসন্তোষ থেকে জাবুর পদত্যাগ করেছেন।

৯ আগস্ট মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমন্বয় কমিটি থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন উপজেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সমন্বয়কারী শাকিল খান এবং সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. রিয়াজ রহমান, মহিউদ্দিন ও কাজী রফিক।

শুরুতে এনসিপি নিয়ে তরুণদের মাঝে যে উম্মাদনা ছিল ছয় মাসেই তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

নেতৃত্বে অযোগ্যতা ও সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ তুলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তারা।

সংবাদ সম্মেলন করে তারা বলেন, ‘দেশের কল্যাণ ও একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। পরে এই কমিটি ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ নামে আত্মপ্রকাশ করলে আমরাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই। আমরা কোনো রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান না হলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজের পাশে থেকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা এবং পারিবারিক চাপে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’

তারা আরও বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, শিবচর উপজেলায় দল পরিচালনার দায়িত্ব এমন কিছু অযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, যারা আদর্শিক, নৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে অযোগ্য। এর ফলে দলের প্রকৃত, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী কর্মীরা যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই ধরনের নেতৃত্বের মাধ্যমে শিবচরে দলের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়।’

এর আগে আত্মপ্রকাশের কয়েকদিনের মাথায় ৭ মার্চ ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজিব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের।

একই দিন পদত্যাগ করেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ। দলের আহ্বায়ক/সদস্যসচিব বরাবর পাঠানো পদত্যাগপত্রে আবু হানিফ লেখেন, ‘আমি জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করছি।’

আবু হানিফ এর আগে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। নাহিদ ইসলামদের দলে ভেড়ার কয়েকদিন না যেতে বেরিয়ে যান।

তরুণদের পাশাপাশি নানা বয়সী অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেছিলেন এনসিপি নিয়ে, যা এখন বিলীন হতে চলেছে।

এদিকে, জুলাই আন্দোলনে পরিচিতি পাওয়া দলটির আলোচিত নেত্রী নীলা ইস্রাফিল পদত্যাগ করেন ২৭ জুলাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এনসিপির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। যদিও নীলা এনসিপির কেউ ছিলেন না বলে দাবি দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।

গোপালগঞ্জের মেয়ে নীলা ইস্রাফিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের গড়া রাজনৈতিক দলে যোগ দেন তিনি। দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাকে নিয়মিত দেখা গেছে।

ফেনীর সোনাগাজী কমিটি গঠনের একদিনের মাথায় দলটি থেকে পদত্যাগ করে বেরিয়ে যান দুই নেতা ইসমাইল হোসাইন ও ইঞ্জিনিয়ার আলাউদ্দিন। কুড়িগ্রামে ২১ জুলাই পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেলা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট আব্দুল বারেক।

হাজীগঞ্জ কমিটি থেকে ৩১ মে পদত্যাগ করেন সমন্বয়ক মুহাঈমেনুল ইসলাম সিফাত। বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ‘অযোগ্য মনে করায়’ পদত্যাগ করেছেন বলে ফেইসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি জানান।

১ আগস্ট শরীয়তপুরে পদত্যাগের ঘোষণা দেন শরীয়তপুর জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম ও সদস্য মো. পলাশ খান।

দু’জনই ফেইসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। কমিটি গঠনে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতির কারণে তারা পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এর আগে ১৯ জুন রাজশাহী বাগমারা উপজেলা কমিটির তিন সদস্য পদত্যাগ করেন। তারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে এবং কেন্দ্রীয় দপ্তরে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে পদত্যাগ করেন।

সিলেটের গোয়াইনঘাট কমিটি থেকে ১৩ জুলাই পদত্যাগ করেন ফাহিম আহমদ (ফাহিম মোনায়েম)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads