আলোচনায় কিংস পার্টি, ইতিহাস কী বলে

Kings Party

রাজাদের যুগ আর নেই, কিন্তু তবু তাদের রাজার দলই বলা হয়। কারণ রাজাদের মতোই ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে এই দলগুলো। অভ্যুত্থানের বাংলাদেশে কি আবার কিংস পার্টি গড়ে উঠছে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্য থেকে দল গঠনের প্রক্রিয়ায় সেই প্রশ্ন আবার সামনে আসছে।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনকালের অবসান ঘটানোয় নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল হবে না, তা প্ল্যাটফর্মটির নেতারা স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু এই আন্দোলনের তরুণ নেতারা অভ্যুত্থানের পরের মাসেই গত ৮ সেপ্টেম্বর গঠন করেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তারা দল গঠনের দিকে এগোচ্ছেন। নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব নিয়েছেন আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম।

নাগরিক কমিটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে বিএনপি নেতাদের মধ্য থেকে আসে প্রতিক্রিয়া। একে কিংস পার্টি গঠনের প্রয়াস হিসাবে দেখার কথা বলেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আর তা যে দেশের মানুষ ভালো চোখে নেবে না, সেই সতর্কবার্তাও দেন তিনি।

তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া আসে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কাছ থেকে। “আমরা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছি না”- একথা বলার পাশাপাশি তিনি বিএনপির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে প্রথম কিংস পার্টি গঠন করেছেন জিয়াউর রহমান। বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি।”

অভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের মধ্য থেকে গঠিত হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে বলতে হবে, ভুল বলেননি তিনি; তবে কিংস পার্টি হিসাবে গঠিত হলেও বিএনপি পরে জনভিত্তিসম্পন্ন দলে রূপান্তরিত হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কিংস পার্টি বা আকস্মিক গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো আসলে ক্ষমতাসীনদের ‘পুতুল’ হিসাবে কাজ করে।

জিয়ার বিএনপির পর এরশাদের জাতীয় পার্টি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগসহ যে দলগুলো সক্রিয় ছিল, তাদের মধ্যে ন্যাপ-সিপিবিসহ প্রায় সবারই রয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। আওয়ামী লীগ ভেঙে একটি অংশ জাসদ গঠন করলেও তাদের পেছনে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা তো ছিলই না, বরং ছিল বিরোধিতা। আর বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে যে বাকশাল গঠন করেন, তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।

ক্ষমতার বলয়ে থেকে প্রথম রাজনৈতিক দল বলা চলে খন্দকার মোশতাক আহমেদের গড়া ডেমোক্রেটিক লীগকে। যদিও ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দলটি গঠিত হয়, তখন মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা মোশতাকের পেছনে ক্ষমতার কেন্দ্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। মোশতাককে সরিয়ে অলি আহাদ পরে এই দলে নেতৃত্বে এসেছিলেন। কিন্তু রাজনীতির গভীর জলে থই পায়নি দলটি।

পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এক সময় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে থাকা সাত্তার জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন।

জাগদল গঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, দৃশ্যত জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশের পথ তৈরির জন্য। পরের বছর ১৯৭৮ সােলর ১ সেপ্টেম্বর জিয়া নিজেই রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন করে এর চেয়ারম্যান হন। তার কয়েকদিন আগে জাগদল বিলুপ্ত করে এর সব নেতারা বিএনপিতে যোগ দেন।

ফলে অরাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় বসে দল গঠনের প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশে জিয়ার হাত দিয়েই শুরু হয়। তবে এই দলের জনভিত্তি তৈরির করার বড় কাজটি করেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালে জিয়া এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে রাজনীতিতে নামেন তিনি। এখনও তিনি বিএনপির চেয়ারম্যান।

জিয়ার মৃত্যুর পর সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করে পূর্বসূরি জিয়ার মতোই উর্দি ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন। তিনিও প্রথম একটি দল তৈরি করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতাদের ভাগিয়ে এনে। ১৯৮৪ সালে গঠিত সেই দলটির নাম ছিল জনদল। তার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে আসা মিজানুর রহমান চৌধুরী।

জিয়ার মতোই দুই বছর পর ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করে এর চেয়ারম্যান হন এরশাদ। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন ঘটলেও তার দলটি অনেক ভাঙনের পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় রয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর এখন এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ভাই জি এম কাদের।

এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন যখন সক্রিয় সব দল বর্জন করে, তখন কিংস পার্টি হয়ে সংসদে যায় একটি মোর্চা, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব। তার নেতৃত্বে ৭২টি নামসর্বস্ব দল নিয়ে সমন্বিত বিরোধী জোট বা কপ, যারা সংসদে ১৯টি আসন পায় কিংবা বলা যায় যে তাদের আসনগুলো দেওয়া হয়।

ওয়ান-ইলেভেনের পর

২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর দুই প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টাও শুরু হয়, যার পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল স্পষ্ট।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, তখন সদ্য নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু কিছু দূর এগিয়েও অবস্থা বুঝে হাল ছেড়ে দেন ইউনূস। পরে তিনি রাজনীতিতে আর না নামার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।

ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী

ইউনূস হাল ছেড়ে দিলেও তখন ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীকে দিয়ে গঠন করা হয় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপি। গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী কোরেশী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার পর তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। দল গঠনের পর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও পেয়ে যান তিনি।

একই সময় গঠিত হয় কল্যাণ পার্টি, এই দলটির নেতৃত্ব দেন সাবেক মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম। তার নবগঠিত দলও ইসির নিবন্ধন পেয়ে যায়। তবে কোরেশী কিংবা ইব্রাহীমের দল নির্বাচনে কিছু দেখাতে পারেনি। তারমধ্যে দুই নেত্রীকে রাজনীতির বাইরে পাঠানোর চেষ্টাও সফল হয়নি।

জরুরি অবস্থার সময়ই কিংস পার্টি শব্দবন্ধটি আলোচনায় উঠে এসেছিল; তা আবার আলোচনায় আসে গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। তখন কল্যাণ পার্টির সঙ্গে নাম আসে সদ্য গজিয়ে ওঠা আরও কয়েকটি দলের। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেপথ্যে থেকে এই দলগুলো গঠনে ভূমিকা রেখে তাদের নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম

এই নির্বাচনের আগেই নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মতো দল। বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকারকে দিয়ে গঠন করা হয়েছিল এই দলগুলো। ভোটে অংশ নেওয়ার পরপরই হারিয়ে গেছে দলগুলো।

তার আগে ২০১৪ সালেও অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আগে নিবন্ধন পেয়েছিল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট বা বিএনএফ। এই দলের আবুল কালাম আজাদ ঢাকার একটি আসন থেকে এমপিও হয়েছিলেন সেবার।

এখন আবার

অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ দেশে কার্যত নেই বললেই চলে। তাদের বেশির নেতা-কর্মী পালিয়ে আছেন, কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। রাজপথে আওয়ামী লীগের কোনো তৎপরতা নেই। ফেইসবুক পেইজে তাদের উপস্থিতি থাকলেও তা কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, তা অজানা।

‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগের ফেরা ঠেকানোর ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়াস যখন চালাচ্ছেন, তখন একেও কিংস পার্টিই বলা হচ্ছে। কারণ তাদের পেছনে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন, তাদের তিনজন উপদেষ্টা পরিষদেও রয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা অবশ্য বলছেন, তারা অরাজনৈতিক ফোরাম হিসাবেই কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে রাজনৈতিক দল তারা করবেন, তা আসবে নতুন নামে। ফেব্রুয়ারিতেই নতুন দলের ঘোষণা আসতে পারে।

জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন দল গঠনের চেষ্টায় রয়েছে

এর বাইরে আরও কয়েকটি দলের ঘোষণা এরই মধ্যে এসেছে, তবে নাগরিক কমিটির মধ্য থেকে গঠিতব্য দল নিয়েই আলোচনা চলছে বেশি, সেই সঙ্গে সমালোচনাও হচ্ছে।

বিএনপি তো সন্দেহের চোখে দেখছেই, পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদস সাকি সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করলে মানুষ সেটাকে ইতিবাচকভাবে নেয় না। ফলে যারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইবে, তাদেরকে এ বিষয়টাতে সচেতন থাকতে হবে। ক্ষমতার সুবিধা না নিয়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, জনগণের ভেতর থেকে যাতে রাজনৈতিক দলের জন্ম নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।”

তবে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন তিনি। এ ধরনের রাজনৈতিক দলকে স্বাগতও তিনি জানাতে চান।

‘কিংস পার্টি’ তকমা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব, ডাকসুর সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, “কিংস পার্টি বলা হলেও এ রকম পার্টির কোনো আলামত বা বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে নেই। একইভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও কোনো ভিত্তি নেই।”

ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের ঘোষণা দিতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে দেশের মানুষ একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তিরও প্রত্যাশা করছেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন তরুণেরা। এ রকম অবস্থায় আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছি।”

নাগরিক কমিটির নেতারা যাই বলছেন না কেন, বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন, সরকারের ছত্রছায়ায় নতুন দল গঠিত হলে তার সফল হওয়া কঠিন, তা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন