ট্রাম্পের কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে, কে এই স্টিভ উইটকফ

স্টিভ উইটকফ।
স্টিভ উইটকফ।

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াস নিয়ে মঙ্গলবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে বৈঠকে বসেছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় এই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।

সৌদি আরব এই বৈঠকের আয়োজন ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এরই মধ্যে বৈশ্বিক মিডিয়ায় বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। মিডিয়ার নজর এখন সৌদি আরবের দিকে। কারণ এই মধ্যস্থতার উপরই নির্ভর করবে, ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে।

তবে বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তিনিই মূলত মঙ্গলবার রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে এই বৈঠকে যোগ দেবেন। ইউক্রেনকে মাঝে রেখে রাশিয়ার সঙ্গে বচসার পুরোটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ উইটকফের ওপর।

উইটকফ নিউ ইয়র্কের এক বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের বন্ধু। সম্প্রতি পর্যন্ত তার কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। ট্রাম্প তাকে একজন ‘দক্ষ আলোচক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে এবং রাশিয়ার কারাগার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মুক্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার আগে স্টিভ উইটকফ ছিলেন তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

কে এই উইটকফ

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার আগে স্টিভ উইটকফ ছিলেন তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা, তহবিল সংগ্রাহক ও গলফ সঙ্গী। নিউ ইয়র্কের নাগরিক প্রতারণা সংক্রান্ত মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় উইটকফ জানান, তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। সে সময় ট্রাম্প মানিব্যাগ সঙ্গে আনতে ভুলে যান, আর উইটকফ তাকে এক দোকান থেকে স্যান্ডউইচ কিনে দেন।

উইটকফ পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন আবাসন আইনজীবী হিসেবে। পরে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান ‘উইটকফ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তিনি এখনো চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রতিষ্ঠান মূলত ম্যানহাটনের বিলাসবহুল উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে।

২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের প্রচার দল উইটকফকে নিয়মিত রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে পাঠাত। দ্য পোস্ট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি জর্জিয়ার গভর্নর ব্রায়ান কেম্প ও জাতিসংঘের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া, তিনি ট্রাম্প ও তার সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী, ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডেসান্টিসের মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। উইটকফ ও তার ছেলে জ্যাক ২০২৪ সালের রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে বক্তৃতা দেন।

প্রোপাবলিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে উইটকফ ট্রাম্পের রাজনৈতিক তহবিলে ২০ লাখ ডলারের বেশি দান করেন।

গত সেপ্টেম্বরে উইটকফ ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ট্রাম্পের সঙ্গে গলফ খেলছিলেন। তখন এক ব্যক্তি গলফ কোর্সের দিকে আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তাক করেছিল। অল্পের জন্য রক্ষা পান ট্রাম্প।

২০২১ সালে উইটকফ ট্রাম্পের রাজনৈতিক তহবিলে ২০ লাখ ডলারের বেশি দান করেন।

রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় উইটকফের ভূমিকা

উইটকফের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি রাশিয়া নিয়েও কাজ শুরু করেছেন। হোয়াইট হাউস ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর অংশ হিসেবে উইটকফের ভূমিকা বিস্তৃত।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, মঙ্গলবার উইটকফ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজের সঙ্গে সৌদি আরবে রুশ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেবেন। বৈঠকের মূল বিষয় হবে ইউক্রেন যুদ্ধ।

গত রবিবার ফক্স নিউজকে উইটকফ বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বৈঠকে অংশ নিচ্ছি। আশা করছি, রাশিয়া-ইউক্রেন প্রসঙ্গে ভালো অগ্রগতি হবে ”

রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই বৈঠক বাইডেন প্রশাসনের পূর্ববর্তী নীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগের প্রশাসন ক্রেমলিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় অনাগ্রহী ছিল।

হোয়াইট হাউস জানায়, উইটকফ সম্প্রতি রুশ কারাগার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষক মার্ক ফোগেলকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ফোগেল তিন বছর ধরে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে বন্দি ছিলেন। তাকে মুক্তি দিতে রাশিয়ার এক ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসায়ীর সঙ্গে বন্দিবিনিময় করা হয়।

ফক্স নিউজের উপস্থাপক শন হ্যানিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফোগেলের মুক্তির জন্য উইটকফ মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাড়ে তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। তবে হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সে সময় ট্রাম্প বিনিময়ের শর্ত নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। তবে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এটি ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এটি যুদ্ধ শেষ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।”

রাশিয়ার সঙ্গে রিয়াদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উইটকফ।

রাশিয়া ও ইউক্রেনকে নিয়ে উইটকফের বক্তব্য

রবিবার ফক্স নিউজকে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধ শেষ হওয়া উচিত। এই যুদ্ধ চার বছর পূর্ণ করতে চলেছে। প্রেসিডেন্ট আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, সঠিক উপায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি নিশ্চিত করতে। আর প্রাণহানি নয়, ইতোমধ্যেই অনেক মৃত্যু হয়েছে।”

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সম্ভাব্য চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেন কি তার উল্লেখযোগ্য ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে পারে? উত্তরে তিনি কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি।

সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা যুদ্ধ সমাধানের কৌশল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। গত সপ্তাহে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইউক্রেনের সম্পূর্ণ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যকে ‘অবাস্তব’ বলে উল্লেখ করেন। পরে তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে তার আগের মন্তব্য পরিবর্তন হতে পারে।

উইটকফের কাছে জানতে চাওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র কি ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করছে? তিনি এ ধারণা নাকচ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ওয়াশিংটন ও কিয়েভের মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। তার ভাষায়, “আমি মনে করি না কাউকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। বরং এটি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া।”

মধ্যপ্রাচ্যে উইটকফের ভূমিকা

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উইটকফ মধ্যপ্রাচ্যে বারবার সফর করেছেন। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও তিনি ওই অঞ্চলে সফর করেন। এসব সফরে তিনি ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্পের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যেমন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে। পাশাপাশি তিনি একজন বন্দির মুক্তি ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি অর্জনের চূড়ান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতে, উইটকফ এই চুক্তি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তা ব্রেট ম্যাকগার্ক, যিনি বাইডেন দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি উইটকফের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের প্রশংসা করেছেন।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর উইটকফ আবারও মধ্যপ্রাচ্যে সফর করেন, আগের আলোচনার সফলতার ভিত্তিতে। জানুয়ারির শেষের দিকে তিনি সৌদি আরব সফর করেন। সেখানে তিনি একটি ‘ব্রড মিডল ইস্ট চুক্তি’ নিয়ে কাজ করেন। এর মধ্যে গাজা পুনর্গঠন এবং ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

তিনি ইসরায়েলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং গাজার কাছাকাছি ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন। এটি ছিল এক দশকেরও বেশি সময় পর গাজা ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তার প্রথম সফর।

তখন উইটকফ ফক্স নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি যা দেখেছি তা উদ্বেগজনক। সব দালান পড়ে গেছে। গাজা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।” গাজার ৩০ হাজার অজ্ঞাত বিস্ফোরিত শেলের কারণে সেখানকার জনগণের চলমান বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এই মাসের শুরুতে ট্রাম্প যখন গাজা থেকে সব ফিলিস্তিনিকে তাড়ানোর এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তখন উইটকফ গাজার সার্ভে ও মাস্টার বিল্ডিং পরিকল্পনা পরিচালনার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন।

ফক্স নিউজ তাকে ট্রাম্পের বিতর্কিত প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন করলে, উইটকফ ট্রাম্পের ‘নতুন ও অনন্য’ ধারণা প্রবর্তনের সক্ষমতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের, যেমন জর্ডান ও মিসরকে নতুন প্রতিক্রিয়া প্রস্তাব করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

রিয়াদে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, ডাকা হয়নি ইউক্রেনকে

আরও পড়ুন