ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশশূন্য হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। তখন ডাকাতের ভয়ে রাত জেগে পাহারা দিতে হয়েছিল রাজধানীর অনেক এলাকার মানুষকে। পুলিশ বাহিনী সচল হওয়ার পর সেই আতঙ্ক কেটেছে। তবে এখন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ছিনতাই।
একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা এবং তাতে কয়েকজনের মৃত্যু জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর শিরোনাম হচ্ছিল। একজন বিদেশিও ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এখন বাংলাদেশের বাইরের সংবাদপত্রেও আসছে সেই খবর। ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা রবিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এই শিরোনাম দিয়ে- “সংখ্যাগুরু আমজনতাও স্বস্তিতে নেই বাংলাদেশে, ঢাকায় ৫ মাসে ৭ জন খুন শুধু ছিনতাইবাজদের হাতে’।
তার আগের দিন বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান প্রতিবেদন ছিল ছিনতাই নিয়ে। তাদের শিরোনাম ছিল- “ঢাকায় একের পর এক ছিনতাই, চলাচলে ভয়’। এক দিন বাদে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) অনলাইনের বাংলা সংস্করণেও ‘রাজধানীতে বেড়েছে ছিনতাই, শিগগিরই বিশেষ অভিযান পুলিশের’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় থাকা কয়েকজন সম্প্রতি ছুরিকাঘাতে খুন হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অভিযোগ তোলে, তারা চোরাগুপ্তা হামলার শিকার হয়েছেন। তখন পুলিশ তদন্ত করে জানায় যে তারা ছিনতাইকারীর শিকার। তার মধ্য দিয়ে ছিনতাই বাড়ার এক ধরনের স্বীকারোক্তি মেলে।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে ছিনতাইয়ের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় রবিবার কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরের ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার খবর এসেছে টিবিএসে।
তিনি রক্ষা পেলেও সবার ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন হচ্ছে না। তেমন একজন হাফেজ কামরুল হাসান। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারী কবলে পড়েন তিনি। তার পেটে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল ফোন ও নগদ ৭ হাজার টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। কামরুলকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গত ১৫ ডিসেম্বর মগবাজারে ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারান হাবিব উল্লাহ নামের এক তরুণ।
প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার ৫০টি থানায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫ জন ব্যক্তি ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। সবমিলিয়ে গত ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা এর অনেক বেশি বলেই ধারণা করা যায়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ মামলা করতে যায় না।
পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রথম আলো দেখিয়েছে, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় সর্বাধিক তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে রাতে ও ভোরে। সেই কারণে এই দুই সময়ে মানুষ চলাচল করতে মানুষ ভয় পাচ্ছেন।
ভোরে ছিনতাইয়ের ঘটনা যে বাড়ছে, সেই স্বীকারোক্তি কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছ থেকেও আসে। তিনি বলেছিলেন, “ছিনতাই বেড়ে গেছে। শেষ রাতের দিকে পুলিশ যখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, তখন ছিনতাইগুলো হয়।”
ঢাকার ছিনতাই নিয়ে কলকাতার পত্রিকা আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, “একাধিক জেলায় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের ঘটনা বার বার শিরোনামে তুলে আনছে বাংলাদেশকে। কিন্তু সে দেশের সংখ্যাগুরু আমজনতাও কি স্বস্তিতে আছেন? গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য কিন্তু সে বিষয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।”
আগস্টের পর বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে ভারতের সংবাদপত্রে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চলছে বলে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিযোগ।
তবে আনন্দবাজারের এই প্রতিবেদনটিতে অবশ্য প্রথম আলোর তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে। একজন চীনা নাগরিকের ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার খবরও দিয়েছে পত্রিকাটি।
ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকায় আসা চীনের নাগরিক লি জিং গত ১১ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার রমনায় সচিবালয়ের উল্টো দিকে ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইকারীরা তার গলায় থাকা সোনার চেইন নিয়ে যায়।
হঠাৎ ছিনতাই বেদে যাওয়ার পেছনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাকে কারণ হিসাবে দেখাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
টাঙ্গাইলেল মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, “দুটি কারণে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। প্রথমত; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকেই এসব কাজে যুক্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয় উঠতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ছিতাইনকারীরা ব্যবহার করছে।”
ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার স্বীকারোক্তি দেওয়ার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, শেষরাতে পুলিশের টহল বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এরপর আরও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশও নড়েচড়ে বসেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) ফারুক হোসেন টিবিএসকে বলেছেন, তারা ডিএমপির আওতাধীন বিভিন্ন ডিভিশনের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং অপরাধ দমনে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
ছিনতাইকারীসহ অপরাধী দমনে ডিসেম্বরে শেষ দিকে ডিএমপি বিশেষ অভিযানে নাতে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, “আশা করছি, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”