স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন? হঠাৎ ভোররাতে সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর এই প্রশ্নটিই প্রথম এসেছিল সাংবাদিকদের মনে। সংবাদ সম্মেলনে কথাটি পাড়লেনও এক সাংবাদিক। জবাবে অবশ্য তিনি উড়িয়ে দিলেন পদত্যাগের গুঞ্জন।
তাহলে তিনি সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন কেন? জানা গেল, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য তিনি কড়া ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন, তা জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে, এটাও জানালেন তিনি। ভোররাতে সাংবাদিকদের ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, “আওয়ামী লীগের যারা এসব কাজ করছে, তাদের ঘুম হারাম করে দেব।”
এসব কথা জানাতে রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকার প্রয়োজন কেন পড়ল? সোমবার দুপুরে সেই প্রশ্নও তাকে করা হলো সাংবাদিকদের মধ্য থেকে।
তার জবাব এল এমন- “আমরা দিনেও যেমন কাজ করি, রাতেও কাজ করি। রাতে সংবাদ সম্মেলন আপনাদের এটা বোঝানোর জন্য করা হয়েছে যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শুধু দিনে নয়, রাতেও কাজ করেন।”
আশ্বস্ত করতে গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও তা আশ্বস্ত করার চেয়ে যে সবাইকে উদ্বিগ্নই বেশি করেছে, তা বুঝিয়ে দিলেন অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ফেইসবুকে লিখলেন, “রাত ৩টায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে যদি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়, তাহলে একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আশ্বস্ত হওয়ার চেয়ে উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত না হওয়ার কি কোনো উপায় আছে?”
আর এক সপ্তাহ পরে রোজা; তখন মুসলমানদের সেহরি খেতে ভোররাতে উঠতেই হবে। সেই চর্চাটিই কি জাহাঙ্গীর আলম আগেভাগে চর্চা শুরু করলেন, এমন কথাও তুলছেন কেউ কেউ।
আবার কেউ কেউ বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরে শীর্ষ পদের চেয়ারে বসলেই কি সবার এমন তালগোল পাকানো অবস্থা হয়?
এমনটা যারা ভাবছেন, তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া চলে না। অন্তত বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে বেঁফাস মন্তব্য শুনতে অভ্যস্থ হয়ে আছেন সবাই।
‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’, ‘দণ্ড ধরে নাড়াচাড়া করায় রানা প্লাজা ধসে পড়েছে’- এমন সব কথা তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকেই শুনেছে বাংলাদেশের মানুষ। তাই জাহাঙ্গীর আলমের আর কী এমন দোষ, তাই ভেবে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। তারপর এরশাদ আমল পর্যন্ত ১১ জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছিলেন। তাদের মধ্যে এরশাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মতিন বিতর্কে পড়েছিলেন। তবে সামরিক শাসনামলে সংবাদমাধ্যমকে চাপের মধ্যে কাজ করতে হওয়ায় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বেফাঁস কথা বললেও তা নিয়ে লেখালেখির সুযোগ খুব একটা ছিল না।
১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র ফেরার পর থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের কথার দাপট বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এম এ মতিন। চিরকুমার এই ব্যক্তি পাঁচ বছরে দায়িত্ব পালনের সময় কথার চেয়ে অবশ্য নানা কাজের জন্য সমালোচিত ছিলেন।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে। রাজনীতিতে নবিস রফিক তার নানা কথায় সরকারকে বিপাকে ফেলতে থাকেন।
১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর তার উপস্থিতিতে পুলিশি হামলা হলে তিনি বিতর্কে পড়েন। তখন তিনি আবার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, পুলিশ কেন হামলা করল, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
রফিক ওই পদে বেশি দিন টিকতে পারেননি। তিন বছরের মাথায় তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বাকি দুই বছর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলান মোহাম্মদ নাসিম।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারটি বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
কিন্তু তিনিও বেফাঁস মন্তব্য করে ফেঁসে যান। একটি শিশু তার বাবার কোলে থাকা অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারালে সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে মন্ত্রী আলতাফ বলেছিলেন- ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে’।
মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কথাটিতে ভুল কিছু না থাকলেও অসময়োচিত ওই উক্তির জন্য ঠাট্টা-বিদ্রুপসহ ব্যাপক সমালোচনায় পড়েন আলতাফ। আড়াই বছরের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয় তাকে।
আলতাফের বিদায়ের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাতে থাকেন তার ডেপুটি লুৎফুজ্জামান বাবর। জেল দেওয়া চুলে, রোদ চশমা আঁটা চোখে ক্যামেরার সামনে আসতেন বাবর। তবে কিছু দিনের মধ্যেই তার কথা-বার্তায় হারিয়ে যায় তার কেশচর্চা।

একের পর এক কথায় উপহাসের পাত্র হতে থাকেন বাবর। তবে সেগুলো থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি। তার সবচেয়ে আলোচিত উক্তি ছিল- ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর তার সেই কথা আজও অনেকের মনে ভেসে ওঠে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় সাহারা খাতুনকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি। সাড়ে ৩ বছর রাখার পর এই পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা।
সাহারা খাতুন বড় সমালোচনায় পড়েছিলেন ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পর। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা করতে না পারায় পড়েন তোপের মুখে, তার জেরে সেই বছরের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
সাহারা বিদায় নেওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। হার্ভার্ডের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই দুঁদে আমলাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পূর্বসূরিদের পথ ধরেন।
২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা যখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত, তখন মহীউদ্দীন খান আলমগীর এই ভবন ধসের জন্যও বিএনপিকে দায়ী করেন। তিনি বলেছিলেন, “কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।”
তার সেই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এক বছরের খানিকটা বেশি সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন মহীউদ্দীন আলমগীর।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় সরকার গঠনের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করেন আসাদুজ্জামান খান কামালকে। এক বছর পর তাকে প্রমোশন দিয়ে পূর্ণ মন্ত্রী করেন।
চাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়া কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রম। কথা কম বলার কারণে তেমন কোনও বেফাঁস কথা তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। ফলে ২০২৮ সালে ও ২০২৪ সালে সরকার গঠনের পর তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদেই রাখেন শেখ হাসিনা। গত বছর অভ্যুত্থানে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত সেই পদেই ছিলেন তিনি।
অভ্যুত্থানের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনকে। কিন্তু পূর্বসূরিদের আছর লাগে তার ওপরও। ফলে মাত্র আট দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে টিকতে পেরেছিলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েই অভ্যুত্থানে নিহত সবার দেহে পাওয়া গুলিগুলো পুলিশের নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন তিনি। এরপর সীমান্তে বিজিবিকে বিএসএফের কাছে পিঠ না দেখাতে বলেন তিনি।
এই দুই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনার কথা বলে বিতর্কের ঝড় তোলেন তিনি। তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হলে তাকে সেই দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমকে। তিনিও নানা মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি করে যাচ্ছেন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এখন তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন সরব হয়েছে। তাতে আবার অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ সংহতিও জানাচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এরই মধ্যে জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবির আন্দোলনে তার সমর্থন রয়েছে।
বিদেশে থেকে অভ্যুত্থানের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন যারা, তারাও জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এক্ষেত্রে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় সেনা কর্মকর্তা হিসাবে তার কর্মকাণ্ডগুলোও তারা সামনে এনেছেন।
অভ্যুত্থানকারীদের মধ্য থেকে কেন জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগের দাবি এখন জোরাল হয়ে উঠছে, তা নিয়ে নানা গুঞ্জনও চলছে।
ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একটি পদ খালি হতে চলেছে। নতুন দলের দায়িত্ব নিতে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করছেন, তা এখন প্রায় নিশ্চিত। আবার ‘অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম এখনও দপ্তরবিহীন।
এখন নাহিদের পদত্যাগের পর উপদেষ্টা পরিষদের পদ পুনর্বণ্টনে মাহফুজকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করার চাপ রয়েছে বলে খবর ছড়িয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো ভাষ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করে নতুন দলের ঘোষণা আসবে। নাহিদ সোমবার পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি বলেই সরকারের তরফে জানানো হয়েছে। তবে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে নাহিদ পদত্যাগের পরই বোঝা যাবে, গুঞ্জনটি নিছকই গুঞ্জন, নাকি তার ভিত্তি আছে।