বছরে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরো হাতবদল হয় অবৈধ অভিবাসনের চ্যানেলে। চক্র ভাঙ্গতে নানা পদক্ষেপ, নানা প্রচারণাও কাজে আসছে না। পাচারকারীদের ‘উদ্ভাবনী চাতুর্যের’ কাছে রীতিমতো নাস্তানাবুদ সীমান্তরক্ষীরা।
এমনই চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি দ্য উইকের এক প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রায় ২০ মাইলের একটি নৌ-রুট গত কয়েক দশক ধরে অবৈধ অভিবাসনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কোনোভাবেই এই রুটের চক্র ভাঙ্গতে না পেরে ব্রিটিশ সরকার গঠন করে ‘বর্ডার সিকিউরিটি কমান্ড’।
যেভাবে কাজ করে চক্র
নৌকায় করে ব্রিটেনে প্রবেশের এই রুটটি ২০১৮ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য এর আগে লরি, ফেরি কিংবা ইউরোটানেল ছিল প্রবেশের পথ। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে ইউরোপে কড়া নজরদারি শুরু হলে বিপাকে পড়ে পাচারকারীরা। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে এসেক্সে ট্রাকে করে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় ৩৯ ভিয়েতনামী অভিবাসন প্রত্যাশীর করুণ মৃত্যু হয়। পাচারকারী চক্র যখন বুঝতে পেলো এই কড়া নজরদারির মধ্যে স্থল পথে সীমান্ত পার হওয়া সম্ভব নয়, তখনই তারা বেছে নেয় নতুন রুট। এ যাত্রায় তারা ব্যবহার করতে শুরু করে ছোট ছোট নৌকা।
মানব পাচারের ব্যবসার কাঠামো
মূলত মোটা অঙ্কের অর্থের হাতছানিতে এই পাচারকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ পথ দিয়ে মানব পাচারের পথ বেছে নেয়।
বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ এগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘ছোট নৌকা, বড় ব্যবসা।’
পাচারকারীরা ইঞ্জিনচালিত সস্তা নৌকা কেনে এবং তুরস্ক ও জার্মানি হয়ে অভিবাসী প্রত্যাশীদের পাচার করে থাকে।
মাথাপিছু দুই হাজার ইউরোর চুক্তিতে এক নৌকায় ৫০ জন করে লোক নেয় পাচারকারীরা। যদিও আট মিটার দৈর্ঘ্য ও দুই মিটার প্রস্থের এসব নৌকার ধারণ ক্ষমতা ১০ জনের বেশি হওয়ার কথা নয়। এর মানে শুধু এক যাত্রাতেই পাচারকারীদের আয় ১ লাখ ইউরো। আর তাদের খরচ বলতে ওই নৌকার দাম।
স্কাই নিউজকে এক পাচারকারী জানিয়েছেন, তিনি গত বছর ১২টি ডিঙ্গি নৌকা চালু করে প্রায় আট লাখ ইউরো রোজগার করেছেন।
কারা এই পাচারকারী
কয়েকজন অবৈধ অভিবাসী যারা বিভিন্ন সময় ওই চক্রের সহযোগিতায় যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন, তারা জানিয়েছেন, এদের অধিকাংশই ইরাকি কুর্দি। অবশ্য ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা ছিল ইরানি কুর্দি।
২০১৯ সালে ওই পথের প্রধান স্থানটির নিয়ন্ত্রণ ইরাকি কুর্দিদের হাতে চলে যায়।
ফ্রান্সের ডাংকাখ থেকে একশ মাইল উপকূলজুড়ে এই পাচারকারী জাতিগত পরিচয় অনুযায়ী জায়গা বণ্টন করে ব্যবসা পরিচালনা করে।
ইরাকের রানিয়া অঞ্চলের কুর্দি পাচারকারীরা ডাংকাখ ও কেলেহ প্রধান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আর ইরানি কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে ওয়েস্ট কেলেহ।
পাচার অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সশস্ত্র এই পাচারকারীদের মধ্যে সংঘর্ষও হয় প্রায়ই। সংঘবদ্ধ এই পাচারকারীদের মধ্যে আলবেনীয় এবং আফগানও রয়েছে। তারা মূলত কুর্দি পাচারকারীদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
কীভাবে দেয় সাগর পাড়ি
অভিবাসী প্রত্যাশীরা ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে প্যারিস, আমস্টারডাম এবং ফ্রাঙ্কফুটে অবস্থান নিয়ে ব্রিটেনে ঢোকার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাচারকারীরাই তাদের হোটেলে রাখে, যাবতীয় খরচও তারাই বহন করে। সাগর যখন শান্ত থাকে, বাতাসের গতিবেগ ১৫ নটের এবং ঢেউয়ের উচ্চতা ৭০ সেন্টিমিটারের কম থাকে, সেই সময়ই পার করার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়।
এ সময় হয় অভিবাসীদের নিয়ে যাওয়া হয় অথবা তারা নিজেরাই ফ্রান্সের উত্তর উপকূলের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় পাচারকারীরা হোয়াটসঅ্যাপে নৌকায় ওঠার লোকেশন পাঠিয়ে দেয়। আর ফ্রান্স উপকূলে পৌঁছানোর পর পাচারকারীদের স্থানীয় সদস্যরা পার হওয়ার নৌকা সরবরাহ করে। সেই নৌকায় করে তারা রওনা দেয়। যাত্রা পথে সময় লাগে চার থেকে আট ঘণ্টা।
নৌকা চালানোর দায়িত্ব এই অভিবাসী প্রত্যাশীদের মধ্যেই কারো না কারো উপর বর্তায়, যিনি কম ইউরো দিয়েছেন অথবা যাকে বিনা খরচে পার করে দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে তাকেই ওই দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এভাবে সাগরপাড়ি দিয়ে ২০১৮ সালে ২৯৯ জন অভিবাসী ব্রিটেনে ঢোকে। তবে সম্প্রতি এ সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে।
২০২২ সালে যা সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ৭৭৪ জন, ২০২৩ সালে এ সংখ্যা কমে ২৯ হাজার ৪৩৭ জন হলেও ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৫০০ জন প্রবেশ করেছে।
এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার অভিবাসী এভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে, যা মোট অবৈধ অভিবাসীর ৮০ শতাংশ। এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবেশের সময় মারা গেছেন অন্তত ২৫০ জন।
সাধারণত বছরের শেষভাগে সাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের ঘটনা বেশি ঘটে। বিশেষ করে গ্রীষ্মে যখন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে।
এসব নৌকায় যারা সীমান্ত অতিক্রম করেন তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশ ইরান, ১৪ ভাগ আফগানিস্তান, ১৩ ভাগ ইরাক, ১২ ভাগ আলবেনীয় এবং সাড়ে ৭ শতাংশ সিরীয়। এছাড়া ইরিত্রিয়া, সুদান, তুরস্ক এবং ভিয়েতনামীও রয়েছে।
২০২৩ সালে এই সংঘবদ্ধ পাচারচক্র গুঁড়িয়ে দিতে একটি যৌথ বর্ডার সিকিউরিটি কমান্ড গঠন করা হয়।
বর্ডার সিকিউরিটির নতুন কমান্ডার পাচারকারীচক্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে বুলগেরিয়ার সহযোগিতায় তুর্কি সীমান্তে এসব অবৈধ অভিবাসনে নিয়োজিত নৌকার চলাচল বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মানব পাচারের প্রচার সরিয়ে ফেলার জন্য টিকটক, ফেইসবুক, ইউটিউব এবং এক্সের সঙ্গেও কাজ করছেন তিনি।
দ্য উইক অবলম্বনে মাহবুবা ডিনা