বিপুল অনুপস্থিতি এইচএসসিতে, দায়ী কি দমন-পীড়ন?

রাজনৈতিক কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের পোস্টে ছেয়ে গেছে ফেইসবুক।
রাজনৈতিক কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের পোস্টে ছেয়ে গেছে ফেইসবুক।

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮০ হাজার। চলতি বছর মোট ১২,৫১,১১১ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা ছিল, যেখানে ২০২৪ সালে অংশ নিয়েছিল ১৩,৩১,০৫৮ জন। এ হিসেবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৬.০১ শতাংশ।

এই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে আলোচনা। কারো মতে তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই পরীক্ষাবিমুখ হয়ে উঠছে, আবার রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণকেও সামনে এনেছেন কেউ কেউ।

এরই মাঝে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দাবি করেছে, তাদের সংগঠন নিষিদ্ধ থাকায় দমন-পীড়নের কারণে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে হাজারো নেতাকর্মী এবছর পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি।

গেল বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতায় অসীন হওয়ার পর তার সরকারের একাধিক সিদ্ধান্তের মধ্যে অন্যতম ছিল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা।

ওই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সংগঠনটির হাজার হাজার নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন বা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন দ্য সান ২৪কে বলেন, “আমাদের বহু নেতাকর্মী কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গ্রেপ্তার আতঙ্ক, মামলা এবং রাজনৈতিক হয়রানির কারণে তারা কেন্দ্রেও যেতে পারেনি। এই সংখ্যা বহু।”

তার দাবি, এবারের পরীক্ষায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছাত্রলীগের কর্মী, যারা দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাসের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি বড় কারণ হতে পারে। একইসঙ্গে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং নীতিগত পরিবর্তনের দিকগুলোও বিবেচনায় রাখা জরুরি।

ঢাকার একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য সান ২৪কে বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইদানিং পরীক্ষাবিমুখ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অটোপাস নেওয়ার জন্য সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি যেমন দেখেছি, তেমনি তাদের অযৌক্তিক দাবি পূরণ হতেও দেখেছি আমরা। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে তৈরি হয়েছে পরীক্ষাহীন সনদ নেওয়ার অভিপ্রায়।

“আমার কাছে মনে হয়েছে, যে বয়সে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে থাকার কথা, সেই বয়সে তাদেরকে অন্যান্য বিষয়ে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, অথবা সেদিকে ধাবিত করা হচ্ছে।”

ওই অধ্যাপকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী হ্রাসের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না।

জবাবে তিনি বলেন, “এটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত নই! এইচএসসি প্রথমবর্ষ থেকেই বহু শিক্ষার্থী এই সংগঠনের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকে। আমাদের কলেজে এবছর বহু শিক্ষার্থী প্রি-টেস্টে অংশ নেয়নি, বিশেষকরে যারা এই ছাত্র সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ছিল।”

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি অনুপস্থিতের হারও অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৮১ হাজার ৮৮২ জন শিক্ষার্থী কম।

পরীক্ষার প্রথম দিনে ৪৩ জন পরীক্ষার্থী ‘অসদুপায় অবলম্বনের’ অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছে; নিবন্ধন করেও অনুপস্থিত ছিলেন ১৯ হাজার ৭৫৯ জন, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।

২০২৪ সালে মোট অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৯৭০ জন। অর্থাৎ অনুপস্থিতির হার ২০২৪ সালে যেখানে ১.০৭% ছিল, তা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ১.৫৬%-এ।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম বলেন, “আজকেও শতাধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে মারধরের শিকার হয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও দেখা যায়নি।”

“শুধু এইচএসসি পরীক্ষা কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের নেতাকর্মীরা প্রবেশ করতে পারছেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরাও যেতে পারছেন না। তাদের অপরাধ, তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ। ইউনূসের অবৈধ সরকারের দমন-পীড়ন থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা তো ভেঙেই পড়েছে, এখন তারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে।”

এদিকে, ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে বলেছে, “অবৈধ-অসাংবিধানিক-জঙ্গি গডফাদার ইউনূসের কারণে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি সমমান পরীক্ষায় প্রায় সোয়া চার লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

“সরকারি উদ্যোগের গাফিলতিতে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।”

সংগঠনটির মতে, শিক্ষার মতো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না। শিক্ষা উপকরণ ধ্বংস, বহিষ্কার, সনদ বাতিল, হামলা-মামলা, আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত, হত্যার হুমকি ও হত্যা প্রভৃতি কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে এরকম বহু পোস্ট চোখে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়।

নিপীড়ন আতঙ্কে পরীক্ষার কেন্দ্রে যেতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফেইসবুকে ভাগ করেছেন তাদের অনুভূতি।

রাদোয়ান আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, “আমার অপরাধ আমি ছাত্রলীগ করি, আমার অপরাধ আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করি, আমার অপরাধ আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন ক্ষুদ্র কর্মী।

“তাই আজকে আমার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও দিতে পারি নাই, আজকে যখন সবাই যখন পরীক্ষা দিচ্ছে তখন আমি নান্দাইল থেকে অনেক দূরে।”

আরিফুল ইসলাম সাজিদ নামে আরেকজন লিখেছেন, “আজকে ছাত্রলীগ করার কারণে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারি নাই। ইতিহাসটা মনে রেখো বাঙালি জাতি।”

“ছাত্রলীগ করার কারণে এলাকায়ও যাইতে পারলাম না, এইচএসসি পরীক্ষাও দিতে পারলাম না,” লিখেছেন, পিয়াম পাটোয়ারী নামে একজন।

কামরুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, “রাজনীতি খাইলো আমার এইচএসসি। অনেক কিছু বলার আছে, আজ আর নয়। বেঁচে থাকলে বিসিএস ক্যাডার হবো।”

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফিনল্যান্ডের নাগরিক গবেষক মতিউর রহমানের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে, তা শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে সামাজিক সংকট- এই দুইয়ের চাপে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটি বড় অংশ আজ ঝরে পড়ার মুখে।

“এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার না করে, বরং রাজনৈতিক দল, সরকার এবং শিক্ষানীতি-নির্ধারকদের দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে,” যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন