যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতীয় রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং রাশিয়া থেকে তেল কিনলে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ জরিমানা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। এটি শুধু বাণিজ্যিক কৌশল নয়, বরং ভারতের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
কেউ কেউ হয়তো একে চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে দর-কষাকষির কৌশল ভাবতে পারেন। কিন্তু এর সম্ভাব্য প্রভাবকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। পূর্ণভাবে কার্যকর হলে এই ব্যবস্থা আমাদের রপ্তানি অর্থনীতিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত দুর্বল করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আমাদের রপ্তানি প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার। এই বাজারে প্রবেশাধিকারে বড় ধরনের পতন আমাদের জিডিপি প্রায় অর্ধ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, যা বৈশ্বিক অনিশ্চিত অর্থনীতিতে আমরা সহ্য করতে পারি না। তাই ঝুঁকি বড় হলেও, আমাদের দৃঢ় সংকল্পও বড় হতে হবে।
ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কারও করুণাপ্রার্থী নয়। আমরা গর্বিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ; আমাদের ন্যায্য স্বার্থ ও সীমা আছে। আলোচকদের সর্বোত্তম চুক্তি করার ক্ষমতা দিতে হবে, কিন্তু শর্ত অযৌক্তিক হলে প্রয়োজনে আলোচনার টেবিল ছেড়ে আসতেও প্রস্তুত থাকতে হবে।
কৃষির ওপর নির্ভরশীল ৭০০ মিলিয়ন ভারতীয়র জীবিকা বিদেশি দাবিতে বিসর্জন দেওয়া যাবে না। দায়িত্বশীল অংশীদার দেশ এটা বুঝবে, বিশেষত যদি সে নিজেও গণতান্ত্রিক হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা বোঝেন না এবং প্রকাশ্যে বলেন, তিনি পরোয়া করেন না।
ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে ট্রাম্পের অবমাননাকর মন্তব্য আসলে স্কুলের মাঠে বড় ছেলে ছোট ছেলেকে অপমান করার মতো, সরাসরি অর্থে নেওয়ার নয়, কিন্তু হেয় করার জন্যই বলা। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
ট্রাম্পের আলোচনার কৌশল অদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু আলোচনা এখনও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, বাণিজ্য দ্বিমুখী রাস্তা। আমাদের আমেরিকান পণ্যের ওপর গড় শুল্ক মাত্র ১৭ শতাংশ, যার কিছু ইতোমধ্যেই কমানো হয়েছে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদকরা ভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতা করতে না পারেন, তবে নিজেদের মূল্য ও প্রতিযোগিতা ক্ষমতা নিয়ে ভাবা উচিত। সব দেশের মতো ভারতেও ক্রেতারা সাশ্রয়ী পণ্যই কেনেন।
ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্যের জন্য শাস্তি দেওয়ার ধারণা একইসঙ্গে অযৌক্তিক ও ভণ্ডামিপূর্ণ। চীন রাশিয়া থেকে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি তেল ও গ্যাস কেনে। তবুও তাদের আলোচনার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের মাত্র ২১ দিন। অর্থাৎ ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে, আর চীনের পণ্যের ওপর থাকবে ৩০ শতাংশ। তাহলে ট্রাম্পের অগ্রাধিকার কী? ভারত–যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক ও চীনের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোথায় গেল?
ইউরোপীয় ইউনিয়নও রাশিয়া থেকে ভারতের চেয়ে বেশি তেল ও গ্যাস কেনে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র–ইইউ বাণিজ্য আলোচনায় এটি কোনও বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও বছরে রাশিয়া থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের সার, ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড ও ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের প্যালাডিয়াম আমদানি করে। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই (জানুয়ারি–মে) যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া বাণিজ্যের পরিমাণ ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা বার্ষিক প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার দাঁড়াবে।
তাহলে ট্রাম্প কীভাবে বলতে পারেন যে ভারতের অর্থ রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে শক্তিশালী করছে, কিন্তু আমেরিকার অর্থ তা করছে না?
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গেও জ্বালানি অনুসন্ধান, দুর্লভ খনিজ অনুসন্ধান ও এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি খাতে কাজ করছে। যদিও পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ লালন, আশ্রয় ও ব্যবহার করার ইতিহাস সুপরিচিত। যদি ওয়াশিংটন মনে করে পাকিস্তানে তেল আছে, তাদের শুভকামনা জানাই। কিন্তু কৌশলগত দ্ব্যর্থতাকে গুণ হিসেবে দেখানো যাবে না, বিশেষত যখন তা বেছে বেছে প্রয়োগ করা হয়।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্য দেয়। আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, কৌশলগত স্বার্থ ও সহযোগিতার ইতিহাস ভাগাভাগি করি। প্রায় ৪ মিলিয়ন আমেরিকান ভারতীয় বংশোদ্ভূত। কিন্তু বন্ধুত্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর দাঁড়াতে হবে, একতরফা দাবির ওপর নয়। অংশীদারদের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা জরুরি। এমন কাঠামো গ্রহণযোগ্য নয়, যেখানে এক পক্ষ শর্ত চাপিয়ে দেবে, আর অন্য পক্ষ প্রশ্ন না করেই মেনে নেবে।
সৌভাগ্যবশত ভারতের হাতে বিকল্প আছে। আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি অন্য দেশের সঙ্গেও অংশীদারিত্বের পথ খুঁজছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার অসহনীয় হলে আমরা বহুমুখীকরণ করব। এটাই ভারতের শক্তি। আমরা কোনও একক রপ্তানি গন্তব্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নই।
এই মুহূর্তে আমাদের আলোচকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারা জাতীয় স্বার্থের দায় বহন করছেন। তাদের সাহস ও স্বচ্ছতা দিয়ে তা রক্ষা করতে হবে। নমনীয়তা একটি গুণ, কিন্তু এর সীমা আছে। চাপের কাছে ভারত মাথা নত করতে পারে না। আলোচনা শুরু করতে হবে উন্মুক্ত মন নিয়ে, কিন্তু চোখও রাখতে হবে খোলা।
যদি ন্যায্য চুক্তি সম্ভব হয়, তা গ্রহণ করব। না হলে মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে সরে আসব। সামনে সবসময় নতুন দিগন্ত অপেক্ষা করছে।
শশী থারুর, সাবেক কূটনীতিক ও ২০০৯ সাল থেকে কেরালার তিরুবনন্তপুরমের সংসদ সদস্য।