বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষার বিষয় যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না, তেমনি অতীতের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও অন্যায়ভাবে আটক করা হচ্ছে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে ।
অবশ্য এনিয়ে সরকারের ভিন্ন ভাষ্য মিলেছে, বলছে ‘একপেশে’ প্রতিবেদন।
এইচআরডব্লিউ বলছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ভিন্নমত দমনে আগের সরকারের মতো এখনো বিশেষ ক্ষমতা আইনে শত শত লোককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মামলা-গ্রেপ্তার, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির কর্মসূচি ঘিরে হতাহতের ঘটনা এবং সম্প্রতি রংপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাটের ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বুধবার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, দমন-পীড়নসহ নানা বিষয়ে গত এক বছরে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক বছর পরও নিজেদের ঘোষিত মানবাধিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের মুখে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়মুক্তি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এখনো রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে যে ভয় ও দমন-পীড়ন এবং ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক গুমের মতো ঘটনা ঘটেছিল, সেটি কিছুটা অবসান হলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে আটক এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য এখনো পদ্ধতিগত সংস্কার সম্ভব হয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আটকে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। সহিংস ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো, যারা বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষার চেয়ে হাসিনার সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী।”
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া নারী অধিকার, সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের বিদ্বেষও বেড়েছে।
রাজনৈতিক মামলা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
সংস্থাটি দাবি করেছে, ২০২৪ সালের ছয়ই অগাস্ট থেকে ২৫ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিরানব্বই হাজার আটচল্লিশটি মামলা করেছে পুলিশ। যার বেশিরভাগই হত্যার অভিযোগে। এক হাজার ১৭০টি মামলায় প্রায় চারশ জন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম রয়েছে।
এছাড়াও অতীতের দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন হিসেবে, পুলিশ শত শত অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ সমর্থককে নির্বিচারে আটক করে এবং আট হাজার ৪০০ জনেরও বেশি লোকের বিরুদ্ধে দশটি হত্যা মামলা দায়ের করে, যাদের বেশিরভাগই অজ্ঞাত।
সংস্থাটি বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার কতটা প্রয়োজন, সেই বিষয়টি সামনে এনেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, উত্তর ঢাকার সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে কমপক্ষে ৬৮টি পৃথক হত্যা বা হত্যার চেষ্টার মামলায় ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে আটক রাখা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ৩৬টি ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিন্নমত দমন করার জন্য আগের সরকারের মতো বিশেষ ক্ষমতা আইনে শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এছাড়াও, ফেব্রুয়ারিতে “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামে একটি অভিযানে আট হাজার ৬০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তারের তথ্য তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে, যাদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে অভিযোগ ওঠেছে।
গুরুতর অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত বলে অভিযোগে অনেক লোককে আটক করা স্বেচ্ছাচারী এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হচ্ছে, বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনা সরকারের অধীনে গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর খুব কম সদস্যের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।
অথচ ওই অভিযানে সমালোচিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ কয়েক ডজন পুলিশ এবং সামরিক ইউনিট জড়িত ছিল বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছেন, “কারও সন্দেহ নেই যে অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রকৃত এবং স্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য এখন আরও অনেক কিছু করা দরকার।”
সরকার যা বলছে
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে বিবিসির কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আখ্যায়িত করেছেন ‘একপেশে’ প্রতিবেদন হিসেবে।
তিনি দাবি করেছেন, “গ্রেপ্তার ও বিচারে হয়রানি রোধে অনেকগুলো আইনগত সংস্কার ইতিমধ্যে করেছি। এসবের উল্লেখ রিপোর্টে নেই।”
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক মামলা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “গত এক বছরে ফ্যাসিষ্ট আমলে দায়েরকৃত প্রায় ১৫ হাজার হয়রানিমূলক মামলা ও কুখ্যাত সাইবার আইনে দায়েরকৃত প্রায় সকল মামলা প্রত্যাহার করেছি।”
রাজনৈতিক প্রতিশোধের বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “প্রতিশোধ বলতে যদি শেখ হাসিনার লোকজনের বিরুদ্ধে মামলাকে বোঝানো হয়, এসব মামলা সরকার দেয়নি। দিয়েছে বিগত আমলে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষ বা তাদের পরিবার।”
বিতর্কিত আইনে গ্রেপ্তার ও অনেক মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, “কিছু কিছু মামলায় নির্বিচারে আসামি করা হয়েছে, এর সাথে মামলা বাণিজ্যে লিপ্ত মানুষও জড়িত থাকতে পারে।”
তিনি দাবি করেন, “আমরা পুলিশকে যথেষ্ট প্রমাণ বা কারণ না থাকলে গ্রেফতার না করার নির্দেশ দিয়েছি।”
এছাড়া “ভূয়া মামলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সম্প্রতি ফৌজদারী আইনের সংস্কার করা হয়েছে,” বলেও উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা।