আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারি চাকরিজীবীদের সোশাল মিডিয়ায় লেখালেখির জন্য হুঁশিয়ার করে দেওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছিল। বলা হয়েছিল, তা স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর আঘাত।
গত বছর অভ্যুত্থানে সেই সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যখন এল, তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে আসার আশাই জাগিয়ে তোলা হয়েছিল।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে যখন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে ফেইসবুকে লেখার জন্য এক ইউএনওর চাকরি গেল, তখন সরকারি চাকরি জীবীরা বুঝতে পারল, বদলায়নি কিছুই।
এরপর এখন সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাতে সামরিক শাসনামলের অধ্যাদেশের ধারা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত সংশোধন আনা হলে সরকারি কর্মচারীদের সভা-সমাবেশ যেমন নিষিদ্ধ হবে, তেমনি চাকরি থেকে বরখাস্ত করাও অনেক সহজ হয়ে যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকার কেন সরকারি চাকরি আইনে এই পরিবর্তন আনছে? সরকারি কর্মচারীরা মনে করছেন, এদিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে ইউনূস সরকার।
প্রথমত, আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করাদের বরখাস্ত করা যাবে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে আন্দোলনে যেতে চাইছেন, তাও দমন করা যাবে।
বাংলাদেশে এখন সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। তাদের কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, ছুটি, শাস্তি সবকিছুই হয় ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ এর মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০১৮ সালে এই আইন প্রণয়নের পর ২০২৩ সালে একবার সংশোধন করা হয়েছিল।
২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়নের পর জিয়াউর রহমানের আমলের অধ্যাদেশটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ইউনূস সরকার এখন সেই অধ্যাদেশের কয়েকটি ধারা ফিরিয়ে এনে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পেলে অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।
কী পরিবর্তন আসছে
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এই আইনের সংশোধনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে গত কয়েক দিনে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
তাতে দেখা যায়, আইন সংশোধন হলে সরকারি কর্মচারীদের রাজপথে সভা-সমাবেশ, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাবে। সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভও করা যাবে না।
কোনো কর্মচারীর কারণে দাপ্তরিক শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটলে তদন্ত ছাড়াই তাকে আট দিনের নোটিসে বরখাস্ত করতে পারবে সরকার। কেউ বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাকেও তদন্ত ছাড়াই অব্যাহতি দেওয়া যাবে। কোনো কর্মচারীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকবে না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৯ এর চারটি ধারা চাকরি আইনে সংযোজন করা হচ্ছে।
এই পরিবর্তন কোন উদ্দেশ্যে?
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ দেশও ছাড়েন। আবার কেউ কেউ দেশে থাকলেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেই আইনের এই সংশোধন।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের এমন সংশোধন ঠিক আছে।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে প্রশাসনে যে দলীয়করণ হয়েছিল, তা থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করতেও চাকরি আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
তবে সামরিক শাসনামলের আইন ফিরিয়ে আনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তারা বলছেন, বিশেষ মানেই হচ্ছে কালো আইন। প্রশাসনে বিরোধিতা নির্মূল করতে যে আইন হয়েছিল, সেই আইন ফিরিয়ে আনাটা উদ্দেশ্যমূলক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তারা বলেছেন, আইনটি সংশোধনের উদ্দেশ্যটি ভাালো মনে হচ্ছে না তাদের।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী একজন ডিসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওই নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি। ফলে তাদের অবসরে পাঠাতে পারছে না সরকার।
“সে কারণে সামরিক শাসনামলের অধ্যাদেশের কিছু ধারা নিয়ে আসা হচ্ছে, যাতে সরকারি চাকরিতে ২৫ বছর পূর্ণ না হলেও কোনো একটি কারণ দেখিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা যাবে।”
বর্তমান আইনে বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়া তাকে অবসরে পাঠাতে পারবে।
আইনটি সংশোধন হলে কারো চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেও তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে।
পুলিশের ৮২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি ওএসডি করা হয়। তাদের অনেকের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি। আবার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১৮০ জন সদস্য এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত।
আইনটি সংশোধন হলে কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশের অনেক সদস্য চাকরিচ্যুত হবেন।
আতঙ্ক-প্রতিক্রিয়া
অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়া সরকারি প্রশাসনে চাকরি আইন সংশোধনের উদ্যোগে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, “সরকারের কোনো উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তে যদি একজন কর্মচারী ভিন্নমত পোষণ করেন কিংবা নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন, সেটিকে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ বলে চাকরিচ্যুত করার আশঙ্কা থাকবে। এ ভয়ে অনেকে নিজের মত জানাবে না।”
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, “যারা ফ্যাসিস্ট, তারা মানুষের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান সরকার তো ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। তাহলে তারা কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে চায় কেন?”
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুত করার বিধান প্রশাসনে ভুল বার্তা দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সংশোধিত আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা করছেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “অনেক নির্দোষ কর্মচারী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। অনিবার্য কারণে যদি সরকার আইনটি সংশোধন করতে চায়, তাহলে তাদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে আইনের অপব্যবহার হবে না।”
আইনটির বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সাংবাদিকরা কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি।
প্রথম আলো জানিয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান তাদের ফোন ধরেননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের প্রধান ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব এ এন এম মঈনুল ইসলাম কথা বলতে রাজি হননি। মন্ত্রণালয়ের বিধি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল শুধু বলেছেন যে আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।