লড়াইয়ের ময়দানে কী করে একা হয়ে গেল ইরান?

সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি। ফাইল ছবি।
সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি। ফাইল ছবি।

গত ১৩ জুন ইসরায়েল বিমান হামলা চালানোর পর জবাব দিতে গিয়ে ইরান দেখল, তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই; সেই থেকে একাই যুদ্ধটি চালিয়ে নিতে হচ্ছে তাকে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে এতদিন ধরে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছিল এই ইরানকে দিয়ে।

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবসহ সুন্নিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে শিয়াপ্রধান ইরান রয়েছে গুরুত্ব নিয়ে। সিরিয়ার মতো প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ থাকত ইরানের পাশে। ইরাক যুদ্ধের অবসান হলেও নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে টক্কর দিতে ইরান ছায়াযুদ্ধের সঙ্গী করেছিল ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরানের হুতিদের।

হিজবুল্লাহ, হামাস, ইরাকি সশস্ত্র শিয়া গোষ্ঠী, সিরিয়াকে নিয়ে একটি ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তৈরি করেছিল ইরান। কয়েক দশক ধরে বিলিয়ন ডলার খরচ করে তা তৈরি করেছিল। কিন্তু হত দুই বছরে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে।

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটেছে, বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের হামলায় নেতৃত্ব হারিয়ে কাবু এখন হামাস-হিজবুল্লাহ। হুতিরা কোনোমতে টিকে আছে। পরাশক্তিগুলো সস্তায় ইরানের তেল কিনে গেলেও চরম দুঃসময়ে অনেকটা গা বাঁচিয়ে চলছে।

এই অবস্থায় একা একটি লড়াই চালাতে হচ্ছে ইরানকে: আর যার সঙ্গে লড়াইটি হচ্ছে, সেই ইসরায়েলকে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য বিশ্বশক্তিগুলোও ইরানের বিপক্ষেই রয়েছে।

ইরানের মিত্রদের হাল-হকিকত তুলে ধরেছে অনলাইন পোর্টাল দ্য নিউ আরব।

হিজবুল্লাহ ধুঁকছে

ইরানের হয়ে প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কার্যকর ছিল লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া দল হিজবুল্লাহ। অথচ এবার ইরানের মূল ভূখণ্ডে বিমান হামলা চলার পর লেবানন থেকে একটি রকেটও ছোড়া হয়নি ইসরায়েলে!

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে সক্ষম সঙ্গী ছিল হিজবুল্লাহ। ফাইল ছবি।

এক বছর আগেও এটা অকল্পনীয় ঠেকাত যে কারো কাছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে অনেকটাই। প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলি হামলা সামলাতে হচ্ছে হিজবুল্লাকে, তাতে দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহও নিহত হয়েছেন। নেতৃত্ব হারিয়ে বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে, হারিয়েছে হামলার সামর্থ্য।

হিজবুল্লাহর বর্তমান নেতা নাঈম কাসেমকে সম্প্রতি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে দেখা গিয়েছিল। অবা্ক করা বিষয় হলো, তার কার্যালয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনির কোনো ছবি ছিল না। অখচ নাসরাল্লাহর সময় তা থাকত।

হিজবুল্লাহর সমরাস্ত্র কমেছে, কমেছে আর্থিক সামর্থ্যও। এক সময় সিরিয়া হয়ে ইরানি অস্ত্র-অর্থ যেত তাদের কাছে। কিন্তু সেদিন আর নেই। গত বছর সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর যারা ক্ষমতায়, তারা ইরানের পক্ষের নয়।

তার ওপর ইসরায়েলর সঙ্গ যুদ্ধ করতে করতে অস্ত্রসম্ভার কমে এখন ধুঁকছে ইরানের গড়া শক্তিশালী দলটি। লেবানন সরকারও হিজবুল্লাহকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে না জড়াতে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।

হামাস রণক্লান্ত

গত প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে হামাস এখন ক্লান্ত। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় হামাসের সব আস্তানা গেছে গুঁড়িয়ে, ইসমাইল হানিয়েহ, ইয়াহিয়া সিনাওয়ারসহ শীর্ষনেতারা একে একে মারা পড়েছেন। বর্তমান নেতা খালেদ মেশাল কাতারে অবস্থান করছেন। মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়া হামাস এখন তাদের ছায়া হয়ে রয়েছে।

ফিলিস্তিনি দল হামাস ইরানের পক্ষে কথা বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ফাইল ছবি।

সিরিয়ায় পরিবর্তন

দুই যুগ ধরে বাশার আল আসাদ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সিরিয়া নানা সময়ে ইরানের পাশে দাঁড়াত। ইরানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের কাজটিও সিরিয়া করত।

গত বছরের ডিসেম্বরে চরমপন্থি ইসলামী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করলে বাশার আল আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। নতুন সরকার ইরানের সঙ্গে আগের মতো সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয়। এরই মধ্যে জানা যাচ্ছে, বাশার আল আসাদের পতনে বিদ্রোহীদের ইসরায়েল সহায়তাও দিয়েছিল।

সিরিয়ায় বন্ধু হারানোর ইরানের আরেকটি ক্ষতিও করেছে, তা হলো প্রতিবেশী এই দেশটি হয়েই লেবাননে কিংবা গাজায় হিজবুল্লাহ ও হামাসের জন্য অস্ত্র-অর্থ পাঠাতে পারত ইরান। এখন তা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইরাকি মিত্ররা এখন চুপ

ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের একটি জোট দীর্ঘদিন ধরে ইরানের স্বার্থ দেখছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের দৌড়ের ওপর রাখছিল। বাগদাদের ক্ষমতা বলয়ে তেহরানের প্রভাব বাড়াতে কাজ করছিল।

কিন্তু এখন আর সেই চিত্র নেই। ইসরায়েল ইরানি ভূখণ্ডে হামলার পর নিন্দা জানিয়েই দায়িত্ব সেরেছে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী। শুধু কাতাইব হিজবুল্লাহ নামে একটি দল হুমকি দিয়েছে লড়াইয়ের, তবে সেটাও এখন নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে হামলা চালায়, তখনই তারা যুদ্ধে নামবে।

ইরাকের মধ্যপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানি তিনিও চুপচাপ। সেই সঙ্গে তিনি ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডারদের ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

হুতিরা অপেক্ষায়

ইরানের মিত্রদের মধ্যে সক্রিয় এখন কেবল ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। ইরানের পক্ষ নিয়ে গত বছর ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল তারা। তবে এখন তারাও অনেকটা চুপচাপ। মার্চ ও এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা হুতিদের সমরাস্ত্রের মজুদে টান ধরিয়েছে। হুতি নেতৃত্ব অবশ্য তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে। তবে তাদের সামর্থ্যেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

পাকিস্তানের নৈতিক সংহতি

পারমাণবিক বোমার অধিকারী একমাত্র মুসলিম দেশ পাকিস্তান প্রতিবেশী ইরানে হামলার পর ‘তীব্র’ নিন্দা জানিয়েছে। ইরানের জনগণের পাশে আছে বললেও এর বেশি আর কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং ইরানের সঙ্গে থাকা ৯০০ কিলোমিটার সীমান্তে বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান, যাতে বিপদাপন্ন ইরানিরা তার দেশে ঢুকতে না পারে।

কিছু সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে যুদ্ধ তীব্র হলে পাকিস্তান তেহরানকে সমর্থন করতে পারে; তবে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, তারা কেবল ‘নৈতিক ও কূটনৈতিক সংহতি’ দেখাচ্ছেন।

বিশ্ব শক্তিগুলোর অবস্থান

ইরানের মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়া এবার সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি। বরং তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে মধ্যস্ততার ভূমিকায় থাকতে চাইছে। অবশ্য ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতির দিকে নজর নেই। ইরানে ইসরায়েলের হামলাকে বিনা উসকানিতে আগ্রাসন’ আখ্যায়িত করলেও তাতে জড়ানোর কোনো আগ্রহ দেখায়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ইরানের অবস্থান।

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় পড়া ইরানের কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনে যাওয়া চীনও কোনো পক্ষ নেয়নি। বেইজিং বলছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সঙ্কটের সমাধান কূটনৈতিক উপায়েই সম্ভব। গত কয়েক বছরে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বিস্তৃত করলেও চীনও এই সময়ে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকাই রাখতে চায়।

এই যুদ্ধ চলার মধ্যেই কানাডায় সম্মেলনে মিলিত হয়েছে বিশ্বের বড় অর্থনীতির সাতটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জাপানের নেতারা।

তাদের বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না। প্রথম হামলা ইসরায়েল করলেও বিবৃতিতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতেই সমর্থন জানান জি-সেভেন নেতারা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন