নিন্দা জানানো কি সরকারের কাজ?

মুহাম্মদ ইউনূস।
মুহাম্মদ ইউনূস।

একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেগুলো পছন্দ করছে না, তা বোঝাতে নিন্দা জানানো হচ্ছে। নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি বাংলাদেশে অতি পরিচিত। যে কোনো বিষয়ে নরমতম প্রতিবাদ হিসাবেই একে দেখা হয়। কিন্তু প্রশ্ন আসছে, যে সব বিষয়ে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেখানে শুধু নিন্দা কেন?

সরকারি নিন্দার এই পর্যন্ত সবশেষ প্রয়োগ হলো ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) শেখ মো. সাজ্জাত আলীর ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া নিয়ে।

এর আগে মাজারের হামলা নিয়েও নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি এসেছিল। নিন্দা জানানো হয়েছিল মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার পরও।

ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যটি আসে গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে। মাগুরায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে সারাদেশে যখনব বাদ-প্রতিবাদ চলছে, তখন তিনি পরামর্শ দেন ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার না করতে।

তার কথাটি ছিল এমন- “ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার করবেন না প্লিজ, আমাদের শুনতে খুব খারাপ লাগে। আপনারা নারী নির্যাতন বলবেন, নারী নিপীড়ন বলবেন।”

তার ওই বক্তব্য ধর্ষণেরে মতো অপরাধের মাত্রা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা হিসাবে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে অধিকারকর্মীরা। তার পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তর থেকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি আসে।

তাতে ববলা হয়, “ধর্ষণ মানে ধর্ষণ, তা সে ৮ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে হোক কিংবা ৮০ বছরের বৃদ্ধার ক্ষেত্রে। এমন জঘন্য অপরাধকে তার যথাযথ নামেই অভিহিত করা উচিৎ।”

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এমন বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা দীপায়ন খিসা ফেইসবুকে লিখেছেন, “সরকারের একজন কর্মচারীর বক্তব্যের নিন্দা জানালেন স্বয়ং সরকার বাহাদুর। আসলে কে বড়???”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক কর্মী দ্য সান ২৪কে বলেন, “এটা অনেকটা এনজিওদের ভাষার মতো হচ্ছে। আগেও সরকারের এমন বিবৃতি দেখেছি। এখানে তো সরকারের দায়িত্ব ব্যবস্থা নেওয়া। নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব সারা নয়।”

সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে শেখ সাজ্জাতের বক্তব্য নিয়ে তিরস্কার জানানো কিংবা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবৃতিতে না পাওয়ার কথাও বলেন ওই রাজনৈতিক কর্মী।

সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদাও মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এ ধরনের বক্তব্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু নিন্দা জানানো বাঞ্ছনীয় নয়।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে উক্তি বা বক্তব্য সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, একটা ধোঁয়াশার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এবং যেটা আইনত গ্রাহ্য না, সেটা যখন কেউ করে তখন তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।”

তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দাবি করছেন, ওই বিবৃতির মাধ্যমে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয়েছে।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে স্টেটমেন্টটা দেওয়া হয়েছে, এটা ওনার জন্য একটা সতর্কবার্তা। এটা দিয়ে ওনাকে সতর্ক করা হলো।”

যদিও প্রেস সচিব স্বীকার করেন, সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল।

নিন্দার প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারে হামলার পরও।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মাজারে হামলা শুরু হয়েছিল।

তখন গত ১৪ সেপ্টেম্বর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি আসে প্রধান উপদেষ্টার। সেই বিবৃতিতে অবশ্য নিন্দার পাশাপাশি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল।

তবে সেই হুঁশিয়ারিতে যে খুব একটা কাজ হয়নি, তা পরিসংখ্যানই বলছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেই গত ১৮ জানুয়ারি জানানো হয়, সাড়ে ৫ মাসে ৪০ মাজারে হামলা হয়েছে।

তবে সংখ্যাটি আরো বেশি বলে মাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি। সম্প্রতি বিশ্ব সুফি সংস্থা নামে একটি সংগঠন দাবি করে, দেশে গত ৬ মাসে ৮০টি মাজার ও দরবার আক্রান্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববার রাতে বরগুনার আমতলীতে একটি মাজারে হামলা হয়।

নিন্দার আরেকটি প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল গড়ত জানুয়ারিতে জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে ‘তৌহিদী জনতা’র নাম নিয়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়ার পর।

এরপর ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “সম্প্রতি মেয়েদের দুটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা বাধা দিয়েছে, তাদের এই কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায় সরকার।”

ওই বিবৃতিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে নারী অধিকারের পক্ষের একজন হিসাবে তুলে ধরে স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয় ওই ম্যাচ দুটি পুনরায় আয়োজনের ব্যবস্থা করতে।

বিবৃতিতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা কেউ ঘটাতে চাইলে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও যারা এরই মধ্যে ঘটিয়ে ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল না।

মেয়েদের ফুটবল খেলায় বাধার পর প্রকাশ্যে নারীদের হেনস্থার ঘটনা ঘটেই চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্থাকারী একজনকে গ্রেপ্তারের পর তাকে ছাড়িয়ে আনতে শাহবাগ থানাও ঘেরাও হয়েছে ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে। তারপর ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়।

এই বিষয়গুলোতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ক্ষোভও জানাচ্ছে।

আরও পড়ুন