বৈরী সম্পর্কের কারণে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তাদের তিক্ততা ‘দুই বেগমের লড়াই’ হিসেবে চিত্রায়িত হত। সময়ের ফেরে বর্তমানে একজন নির্বাসনে, আর অন্যজন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশও নতুন বাঁকে।
এমনই প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের রাজনীতির হিসেব-নিকেশে ভিন্ন বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার অবস্থার অবনতি হওয়ায় দিল্লিতে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনা ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
বার্তা সংস্থা আইএএনএস লিখেছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইমেইলে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়ার দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।
একইদিন লন্ডনে নির্বাসনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকেও এসেছে সহমর্মিতার আভাস। বলেছেন, প্রতিশোধের রাজনীতির অবসান চান তারা। বিএনপি মহাসচিবের মুখেও একই বক্তব্য শোনা গিয়েছিল সম্প্রতি।
আর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার স্মৃতি স্মরণে নিয়ে কিছুদিন আগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, দুই দল থেকে তাদের নেত্রী ও পরিবারকে মাইনাস করার খেলা এখনও চলছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওয়ান-ইলেভেনের মাইনাস টু ষড়যন্ত্রের কথা প্রথমবারের মতো সামনে এনেছিলেন।
যদিও ভিন্ন বাস্তবতায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে তখন তা অন্য সবাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন সময় যত গড়াচ্ছে সে সন্দেহ ততই ডালপালা ছড়াচ্ছে।
শেখ হাসিনার উদ্বেগ
সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়ার বর্তমান সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থা এবং তিনি যেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই হাসপাতালে নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়েছেন শুনে আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমি প্রার্থনা করি তিনি যাতে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পরিচিতি ‘দুই নেত্রী’ হিসেবে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে তারা দুজন মোট ৩০ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখা দুই নেত্রীর বিচ্ছেদের সূচনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, তবে প্রাণ হারান তখনকার মহিলালীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ কয়েক ডজন নেতাকর্মী।
এরপর ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ঘিরে দলগত তিক্ততা বাড়লেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুজনকেই কারান্তরীণ হতে হয়। তখন ‘মাইনাস টু’র আলোচনা চাউর হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এরপর অবশ্য দুই নেত্রী ছিলেন জাতীয় সংসদ এলাকায় করা সাবজেলে, পাশাপাশি ঘরে।
তবে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুতে সমবেদনা গেলে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুলশান অফিসের গেট থেকেই ফিরিয়ে দেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকেই দুই নেত্রীর মুখ দেখাদেখি চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারেও পাঠানো হয়। দুই বছর পর মহামারীর মধ্যে শর্তসাপেক্ষে সাজা স্থগিত করে তাকে সাময়িক মুক্তি দেন শেখ হাসিনা।
এরপর বেশ কয়েকবার খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার দল ও স্বজনরা চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিতে চাইলেও সে অনুমতি শেখ হাসিনার সরকার তখন দেয়নি।
তারেকের বার্তা
শেখ হাসিনা তার প্রতিপক্ষের নেত্রীর সুস্বাস্থ্য কামনা করে সাক্ষাতকারের সঙ্গে বুধবার ১০ ডিসেম্বরে তারেক রহমানের বক্তব্যের যোগসূত্র খুঁজছেন কেউ কেউ।
এদিন নিজের ফেইসবুকে এক পোস্টে তারেক রহমান লেখেন, বিএনপি প্রতিশোধের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করছে। তারা সমাধানের পথে বিশ্বাসী।
“আমরা এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কোন বাংলাদেশীকে রাষ্ট্রের ভয়ে বাঁচতে হবে না। তা সে সরকারের সমর্থক হোক বা বিরোধী। মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানবাধিকারই মানুষের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার মৌলিক শর্ত।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও উল্লেখ করেন, “আজ বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনীতির চেয়েও বড় কিছু। একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ যেখানে সবার জন্য মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। যেখানে কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে।”
“কখনও কখনও কষ্ট মানুষকে আরও মহান করে তোলে। দেশনেত্রী আমার মা এটাই প্রমাণ করেছেন। তিনি শিখিয়েছেন, যে অন্যায় আমরা সহ্য করেছি তা যেন আর কারও জীবনে না আসে। দেশকে বদলাতে হলে ঘৃণার পথ নয়, ন্যায় নৈতিকতা আর ক্ষমাশীলতার পথেই ভবিষ্যৎ গড়ে।”
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারেক রহমান। তার আগে মা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হাওয়া ভবনে বসে তিনি সব কিছু চালাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়ার পরের বছর রাজনৈতিক সমঝোতায় মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তারেক লন্ডন চলে যান, তারপর আর ফেরেননি।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা তার মা’কে দেখতে তারেক রহমান ফিরবেন বলে শোনা গেলেও তিনি জানিয়েছেন, তার ফেরাটি তার ইচ্ছাধীন নয়। কিন্তু কার ইচ্ছাধীন, তার জবাব তিনি দেননি।
‘মাইনাস ফোরের’ আশঙ্কার মধ্যে হাসিনাপুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় কিংবা তারেক রহমানের বার্তা, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে শেখ হাসিনার ইতিবাচক মনোভাব কি নতুন কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে?



