অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হবে কি না- এনিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন, এই সরকারে অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক। একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে উপদেষ্টাদের কণ্ঠেও। তবে রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসা বা পরিস্থিতির জন্য বিএনপির দায় রয়েছে মনে বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, সারাদেশে দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে বিএনপির কর্মীরা। সে কারণে মানুষ আগের সরকারের সঙ্গে তাদের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছে না।
অনির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর বা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করেছে বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। এ সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, সেটা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান-এসব কর্মকাণ্ডের ওপরই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্ভর করবে বলে একটা ধারণা রয়েছে সব অংশীজন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এখন নির্বাচন ডিসেম্বরে নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে, এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে এই বিতর্কের মধ্যে কিছুদিন ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গে নানা আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে। এই আলোচনা ভিন্ন মাত্রা পায় সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও রাজনীতিকদের কারও কারও বক্তব্যে।
গত ১০ই এপ্রিল সুনামগঞ্জ সফরে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, “ওই রাস্তা থেকে আমারে বলতেছিল, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন।”
এদিকে গত ১২ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, “আমরা অনির্বাচিত- এই কথা কে বলল? আমাদের তো ছাত্ররা, জনতা- যারা নাকি এই পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে, তারাই সরকার গঠন করেছে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত আমরা।”
তাদের এই বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায় কি না, এই প্রশ্ন তুলে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে ইঙ্গিত করে তিনি এ-ও বলেন, “দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইলে নির্বাচিত হয়ে আসেন। অনির্বাচিত কাউকে দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় মেনে নেবে না।”
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পেছনে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ায় বিষয়টিও অন্যতম একটি কারণ।
লেখক, বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভোট হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এই ধারণা থেকে দলটির নেতাকর্মীরা সারাদেশে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।”
মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, নেতাকর্মীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মানুষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে একটি অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খসড়ার শিরোনাম করা হয়েছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’। যাতে সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট না করে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংসদ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না করার পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকবে।
এই সরকারের কোনো কার্যক্রমের বৈধতা সম্পর্কে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা তা অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না, এমন কথাও বলা হয়েছে এতে। বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলাও করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সুশাসন, আইনের শাসন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা সব কিছুই ভেঙে পড়েছে। আর এটা সংস্কারে কাজ তিন বা ছয় মাসের কাজ নয়। নির্বাচন দিতে হলে নির্বাচন কমিশনের যে সংস্কার সেটা করতেও তো সময় লাগবে। আসলে এই সরকারের উদ্দেশ্য শুধু নির্বাচন নয়। এর মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্র সংস্কার। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই সরকারকে গ্রহণযোগ্য সময় দিতে হবে।”
তার কথায়, “রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় ওই সংস্কারের সুফল নাও পাওয়া যেতে পারে।”
আর ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ফররুদ্দিনের সেনা সমর্থিত সরকার ছিলো দুই বছর। আর এই সরকার ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হয়েছে। দেশের মানুষের একটি আকঙ্ক্ষা আছে তাদের কাছে। তাই সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার ওপর এই সরকারের মেয়াদ নির্ভর করছে।”
তবে ভিন্ন মত রয়েছে অনেকের। একটি অনির্বাচিত সরকার নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘ সময় থাকলে, এই সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই নির্বাচিত সংসদে বৈধতা দিতে হবে। সেখানে অনির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর বা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারের সময় দীর্ঘ হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেটা আমাদের চিন্তার ও ধারণার আড়ালে থাকতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে এ সরকারের লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা কঠিন।”
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক জরিপে বলা হয়, এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর বা তার বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৪৭ শতাংশ ভোটার। আর ৫৩ শতাংশ মনে করেন, এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত।
বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছিল।
তবে এই জরিপের ছয় মাস পর দেশের প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে মানুষের মনোভাব বদলাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবিষয়ে বিভিন্ন মতামত দেখা গেলেও বেসরকারিভাবে কোনো জরিপ প্রকাশ হয়নি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, ডয়চে ভেলে, ডেইলি স্টার, প্রথম আলো।