ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি’র দম কি ফুরিয়ে গেল?

গত পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা।
গত পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা।

“এনসিপি ইজ আ গন কেইস”- ফেইসবুকে কথাটি লিখছেন অনেকে। এনসিপি মানে জাতীয় নাগরিক পার্টি। উড়তে থাকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে ধুলোয় নামিয়ে আনা অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের গড়া রাজনৈতিক দল।

দুই মাসও হয়নি দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন এখনও হয়নি। তাহলে এখনই কেন তরুণদের এই দলের দম ফুরোনোর আলোচনা?

এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে চার দিন আগে গত ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঢাকা মহানগর কমিটির বর্ষবরণের আয়োজন।

ঢাকার ইস্কাটনে সড়কে এই অনুষ্ঠানে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জনসমাগম ছিল না বললেই চলে।

অনেকটাই দর্শক-শ্রোতাহীন সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করে ঠেস দিয়ে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ।

একজন লিখেছেন, “সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল এনসিপির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল নেমেছে। ঢাকায় ব্যাপক যানজট। নাগরিক পার্টি আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ দর্শকের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন NCP নেতা!”

আরেকজন লিখেছেন- “সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল এনসিপির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি মানুষ চলে এসেছে। ঢাকায় তীব্র যানযট এর সৃষ্টি হয়েছে। বাকিটা ভিডিওতে দেখে নিন।”

ওই অনুষ্ঠানের ৬/৭টি ছবি দিয়ে এনসিপি তাদের ফেইসবুক পাতায় যে পোস্ট দেয়, নগন্য উপস্থিতি নিয়ে মন্তব্যের ঘর ভরে উঠেছে। একজন লিখেছেন- “দর্শক সারিতে সাংবাদিক ছাড়া ৫০ জন লোকও তো নেই।”

পোস্টে কেবল মঞ্চের ছবি দেওয়া নিয়ে একজন মন্তব্য করেছেন- “এইতেই বলি শুধু স্টেজের ছবি কেন!”

গত পহেলা বৈশাখে জাতীয় নাগরিক পার্টির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জনসমাগম ছিল না বললেই চলে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাউস কমিটি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির অনুষ্ঠানে হতশ্রী উপস্থিতি দেখে অনেকে এই দলটির শেষ দেখে ফেলতে চাইছেন।

তবে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন তাদের অনুষ্ঠানে জনসমাগম কম থাকার ব্যাখ্যা দিয়ে এক টিভি আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, “দল হিসেবে আমরা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। আমাদের শুধু একটি সেন্ট্রাল কমিটি রয়েছে। যেখানে নিরলসভাবে কাজ করছেন ২১৭ জন সদস্য। এই সদস্যদের কাঁধেই পুরো দেশের সাংগঠনিক দায়িত্ব।

“বর্তমানে আমাদের অনেকেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাজ করছেন। এই কারণে ঢাকায় উপস্থিতির সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কম ছিল।”

তবে অনেকেই ভাবছেন, এনসিপির অনুষ্ঠানে স্বল্প উপস্থিতি তাদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

সাংবাদিক শাহেদ আলম লিখেছেন, “এনসিপির ফেইসবুক উপস্থিতি বনাম সব কেন্দ্রীয় নেতাদের মঞ্চে থাকার সময়ে বাস্তব উপস্থিতি । নাহিদ যখন বক্তব্য দিচ্ছেন, কার্যত মঞ্চের সামনে কেউই নেই।”

স্বল্প উপস্থিতির কারণ নিয়ে তিনি বলেন, “জামায়াত-শিবির তাদের সব সমর্থন, সরিয়ে নেওয়া ও জন সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াতে কি এই জনশূন‍্যতা?

“এটা ঢাকার চিত্র হলে, জেলা শহরে তো মানুষ তাদেরকে চিনবেই না। সংসদে আসন পাওয়া তো দুরের কথা।”

এনসিপির গোড়ায় গলদ দেখার কথা জানিয়ে শাহেদ আলম লিখেছেন, “এনসিপির রাজনীতিটা আসলে কী? এ ২ মাসে তাদের কোনো স্লোগান আপনি মনে রেখেছেন? কেন অপরাপর রাজনৈতিক দল থাকতে এনসিপির রাজনীতি করবেন আপনি? কেবল ‘বিএনপি খারাপ, নির্বাচন চায়, আমরা নির্বাচন চাই না’- এ স্লোগানে আপনার রাজনীতি দাঁড়াবে?”

প্রবাসী সাংবাদিক, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনীম খলিল ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমার মাঝে মাঝে মনে হয় জানাক/এনসিপির নীতি-নির্ধারণী পজিশনে এমন কেউ আছে, যার কাজই হলো একটার পর একটা ফটকামি আইডিয়া বের করা যার মাধ্যমে জানাক/এনসিপি চরম হাস্যকর একটা গ্রুপিংয়ে পরিণত হয়।

“এরা একটা করে উদ্ভট দাবি থ্রো করে, সেই দাবি নিয়ে কয়েকদিন হাউকাউ করে, তারপরে সেই দাবি হাস্যকরভাবে ফেইল করে। এইরকম সম্ভাবনাময় তরুণদের একটা দল এত দ্রুত ন্যাশনাল কমেডি পার্টি হয়ে যাচ্ছে, দেখতেও খারাপ লাগে।”

সেই পোস্ট শেয়ার দিয়ে প্রবাসী কলামিস্ট মারুফ মল্লিক লিখেছেন, “এই জন‍্যই আমি বলি এনসিপির থিংক ট‍্যাংক বলে কিছু নাই। অথচ ছেলেগুলোর সম্ভাবনা ছিল।”

লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের একটি বক্তব্যও অনেকে পোস্ট হিসাবে দিচ্ছেন নিজের ওয়ালে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “পার্টির প্রধান নেতা নাহিদ ভাষণ দিচ্ছেন, অন্য বড় নেতারাও মঞ্চে উপস্থিত, কিন্তু শ্রোতার আসন ফাঁকা। ছাত্র নেই। শ্রমিক নেই। জনগণ নেই। ঘটনাটি রাজনীতিক শিক্ষার বড় উৎস হতে পারে।”

মহিউদ্দিন আরো লিখেছেন, “ফেইসবুকের লাখ লাখ লাইক-কমেন্ট যে রাজনীতিক জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার নয়, তা ছাগলরা মানতে চায় না। আমি ১০ লাখ ছাগলের কাছে জনপ্রিয়, ১০ লাখ ছাগল আমার স্ট্যাটাসে লাইক দেয়, এটা দিয়ে আমি রাজনীতিক ওজন মাপবো?

“গত ২০ বছরে একটি জিনিস খুব দেখেছি। ছাগলের মন জোগাতে গিয়ে বহু রাজনীতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে। এনসিপির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। পায়ের তলার সব মাটি কোদাল দিয়ে সরিয়ে এরা ছাগলের খামারে আশ্রয় নিয়েছে।”

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের সমাবেশে সারাদেশ থেকে নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছিল।

বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে নয় মাস আগে যে নাহিদের ডাকে লাখো মানুষ দিয়েছিল সাড়া; মন্ত্রীর পদমর্যাদা ছেড়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদ যখন এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন, তখন তার সামনে ছিল হাজারো মানুষ।

এখন তা কমে যাওয়া মানে এনসিপি গুরুত্বহীন হয়ে পড়া কি? ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাই ভাবছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার হঠানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে শিক্ষার্থীদের নামানো হয়েছিল, দল গঠন করাও হয়। অভ্যুত্থান সফল হওয়ায় এখন নেপথ্যের কুশীলবদের কাছে শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

নির্বাচন প্রশ্নে অন্য প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া এনসিপির সমর্থকরা অবশ্য এখনই আশা ছাড়তে নারাজ।

তাদের একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “এনসিপি বড় ছক্কা মারার পথে। কারণ ছক্কা মারার মতন সহজ বলটা তৈরি কইরা দিছে শক্তিশালী দলগুলা ইউনুস সরকারকে বেহুদা চাপ দিয়া। এনসিপি সেই সুযোগটা নেবে।

“একটা মিটিংয়ে লোক কম আসছে বইলা যারা মনে করছেন এনসিপি শেষ, তারা খুব তাড়াতাড়িই বাস্তবতায় ধাক্কা খাইবেন … অপেক্ষা করেন, আরো অনেক ওভার বাকি আছে।”

বিএনপিসহ অন্য দলগুলো যখন দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, তখন এনসিপি আগে চাইছে সংস্কার। তা না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা একদিন আগেই দেন নাহিদ।

এদিকে নির্বাচনের জন্য দল নিবন্ধনের কাজও ‍গুছিয়ে চলছে এনসিপি। বৃহস্পতিবারও নির্বাচন কমিশনে যান দলটির নেতারা। সেখানে তারা নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের সময়সীমা ৯০ দিন বাড়ানোর অনুরোধ করে আসেন।

ইসিতে দেওয়া এনসিপির চিঠিতে নতুন দল নিবন্ধনের শর্থ শিথিল করে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশ কার্যকরের দাবি জানানো হয়।

মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার সময় নিজেদের নিয়োগকর্তা হিসেবে ছাত্রদের তুলে ধরলেও এখন নানা প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে অভ্যুত্থানকারীদের দূরত্ব বাড়ছে।

নাহিদ একদিন আগেই বলেছিলেন, “বর্তমান সময়ে যে মাঠ প্রশাসন রয়েছে, সেই মাঠ প্রশাসন মনে হচ্ছে নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে এবং সেসব জায়গায় প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করছে।”

ছাত্ররা সরকারে থাকলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না- বিএনপির এই কথার পাল্টায় নাহিদ বলছেন, “আমরা দেখছি, প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে অনেক জায়গায়। মাঠপর্যায়ে যেসব জায়গায় চাঁদাবাজি চলছে, সেই জায়গায়ও প্রশাসন আসলে নীরব ভূমিকা পালন করছে। আমরা বলেছি, এ ধরনের প্রশাসন যদি থাকে তাহলে এর অধীনে নির্বাচন করাটা সম্ভব নয়।”

সরকারে না থেকেও সরকারি ব্যর্থতার জের টানার কথা বলেন নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কের পদধারী অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী দিলশানা পারু।

তিনি লিখেছেন, “এনসিপির সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো সরকারের সকল ব্যর্থতা এনসিপির ঘাড়ে বর্তায় কিন্তু সরকারের সকল সফলতা কিন্তু শুধু সরকারের ওইখানে। কিন্তু এনসিপির কোনো ক্রেডিট নাই!”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads