ইসলামী দলগুলোকে জড়ো করছে জামায়াত, ভাবনা বাড়ছে বিএনপির

গত জুলাই মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর এই সমাবেশে বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতারা ছিলেন আমন্ত্রিত।
গত জুলাই মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর এই সমাবেশে বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতারা ছিলেন আমন্ত্রিত।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়; জামায়াতে ইসলামী তো বটেই, বাংলাদেশ প্রায় সব ইসলামী দল ছিল বিএনপির ছায়াতলে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর সেই চিত্র গেছে বদলে।

অভ্যুত্থানের পর বিএনপি যখন মধ্যপন্থী দল হিসেবে নিজেদের মেলে ধরার চেষ্টায় ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছে; তখন তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টায় জামায়াত ইসলামী দলগুলোকে তাদের ছায়াতলে আনতে তৎপর হয়ে ওঠে।

ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কাছে ছাত্রদলের ভরাডুবির পর চনমনে হয়ে ওঠা জামায়াত এবার আরেক কাঠি এগিয়ে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার পথে এগোচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল সংসদে নির্বাচনে অনুবাদ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও জামায়াতের এই তৎপরতা সন্দেহ তৈরি করেছে বিএনপির মধ্যে।

এটা কি সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কোনো ষড়যন্ত্র, নাকি নির্বাচনে জোট গঠনের ‘ড্রেস রিহার্সাল’, তার কূল-কিনারা এখন খুঁজে ফিরছেন বিএনপি নেতারা।

বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণে বরাবরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল বাম ও মধ্য-বামপন্থী দলগুলো। বিপরীতে ডানপন্থীদের আশ্রয় ছিল বিএনপি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি যে চারদলীয় জোট গঠন করে, তাতে জামায়াত যেমন ছিল; ইসলামী ঐক্যজোটও ছিল সেখানে, যা ছিল অনেকগুলো ইসলামী দলের মোর্চা।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর কয়েকটি ইসলামী দলে ভাঙন ধরিয়ে তাদের বিএনপি জোট থেকে বের করতে পারলেও অধিকাংশগুলোকে পারেনি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাদের পুরনো মিত্রদের রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুললেও পুরনো মিত্রদের ভোট করতে ধানের শীষ প্রতীক ঠিকই দিয়েছিল।

তবে এরপর জোট সক্রিয় না করে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল নেয়, যা নিয়ে জামায়াত ক্ষুব্ধ ছিল। অভ্যুত্থানের পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে মতভেদ এখন প্রকাশ্য। অতীতের বন্ধুতা এখন বৈরিতায় গড়িয়েছে। উভয় দলের নেতারা কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কইছেন না।

এরমধ্যেই যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল নিয়ে জামায়াতের উদ্যোগী হওয়ার খবর দিয়েছে বিবিসি বাংলা।

রোববার তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়নসহ পাঁচ দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী কয়েকটি দল ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। তাদের কর্মসূচি এক থাকলেও ঘোষণা আসছে আলাদা আলাদা সংবাদ সম্মেলন থেকে।

খেলাফত মজলিস রোববার সংবাদ সম্মেলন করে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক হিসেবে কর্মসূচি ঘোষণাও করেছে। তারা ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করবে। পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ মিছিল করবে বিভাগীয় শহরগুলোতে। জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল করবে ২৬ সেপ্টেম্বর।

অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করতে সোমবার জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না করে নির্বাচন করলে পুরোনো ‘স্বৈরাচারী’ ব্যবস্থা ফিরে আসবে বলে তারা মনে করেন। সে কারণে সংস্কারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিচ্ছেন তারা।

যে পাঁচ দফা দাবিতে তাদের আন্দোলন, তার প্রথমটিই হচ্ছে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; যদিও জুলাই সনদই এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

আওয়ামী লীগের পর তাদের মিত্র দল জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলীয় জোটের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে তাদের। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান করার দাবিও তারা তুলছে।

জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিচ্ছে ইসলামী দলগুলো। এছাড়া ভোটের আনুপাতিক হারে বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিও তাদের রয়েছে।

বলা হচ্ছে, এই যুগপৎ কর্মসূচিতে যো দিতে পারে আটটি দল। তার মধ্যে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের পাশাপাশি অভ্যুত্থানকারী তরুণদের গড়া দল এনসিপিও রয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের স্থায়ী স্বীকৃতির জন্য জুলাই সনদ প্রণয়নের জোর দাবি রয়েছে এনসিপির। দলটি সংবিধান বদলে দিতে সংসদ নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায়।

এসব বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে তাদের অবস্থান কাছাকাছিই থাকছে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনেও তারা দুই দল একমত। এসব বিষয়ে আবার বিএনপির রয়েছে ভিন্ন মত।

বিএনপির চাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে আনার পরই অসন্তোষ জানিয়েছিল জামায়াত ও এনসিপি।

এখন ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে জামায়াতের আন্দোলনে নামার পেছনে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কোনো গুপ্ত অভিসন্ধি রয়েছে কি না, তার খোঁজ নিচ্ছেন বিএনপির নেতারা।

দলটির একাধিক নেতা এনিয়ে তাদের সন্দেহের কথা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন। তাদের একজন বলেন, “সংস্কার বা জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলছে। কিন্তু আলোচনার টেবিল থেকে বিষয়টিকে রাজপথে আনা হচ্ছে; যা নির্বাচন প্রশ্নে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে।”

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবাবলি সমন্বিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন।

সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর একমত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সংবিধান সংস্কারের মূল কিছু বিষয়ে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে বিএনপির বিপরীত অবস্থান নিয়েছে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো।

বিএনপি চাইছে, যা কিছু সংস্কার, ভোটের পরে নির্বাচিত সংসদই তা বাস্তবায়ন করবে। জামায়াত চাইছে, আগে সংস্কার এবং সনদ বাস্তবায়ন, তার ভিত্তিতে নির্বাচন।

এদিকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের পথে যে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, তা যদি হয়েই যায়, তাহলে ইসলামী দলগুলো যাতে জোটগতভাবে অংশ নিতে পারে, জামায়াত সেই ছকই গুছিয়ে আনছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখনও চার-পাঁচ মাস আছে নির্বাচনের। ফলে তারা যে দাবিগুলো এখন তুলছে, এগুলো হলেই তো নির্বাচন হয়ে যাবে। ফেব্রুয়ারি আসতে আসতে এগুলো হলেই তো নির্বাচন হয়ে যাবে।”

তবে এই আন্দোলন নির্বাচনী জোটের দিকে গড়াবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট করছে না দলগুলোর নেতারা। তারপরও বিএনপির জন্য সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন