সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ৩০০ প্রার্থী? ইতিহাস ঢুঁড়ে এমন কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও আগামী সংসদ নির্বাচনে তা-ই করার প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। শুধু তাই নয়, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ জয় জামায়াতের নেতাদের আশার পালে দিচ্ছে হাওয়া।
জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেই ফেলেছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফল আগামী সংসদ নির্বাচনেও প্রভাব রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
শনিবার জামায়াতের নারী শাখার মজলিসে শুরার বৈঠকে তিনি বলেন, “ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় লাভ করেছে। এ বিজয়ে অনেকেই অভিভূত হয়েছেন। এ নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে, ইনশাআল্লাহ।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছে।
এখন অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এর নির্বাচন হয়েছে। এমাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনেই জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নিষিদ্ধ ছিল। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সরকারের আদেশে নিষিদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি।
এদিকে অভ্যুত্থানের পর চাঙা হয়ে রাজনীতিতে ফেরা জামায়াতে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপিকে ছেড়ে আলাদাভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সেজন্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ তারা শুরু করে বেশ আগেই।
জামায়াত আমির শনিবারের সভায় বলেন, “যারা আমাদের পছন্দ করেন, ভালোবাসেন এবং আমরা যাদের পছন্দ করি, ভালোবাসি, তাদের নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনে তিনশত আসনে নির্বাচন করার আশা করি।”
কাদের নিয়ে নির্বাচন করবেন, তা তিনি স্পষ্ট না করলেও ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। পাশাপাশি অভ্যুত্থানকারীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গেও রাখছে যোগাযোগ।
তবে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সাপে-নেইলে হয়ে উঠেছে। জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি এতদিন নীরব থাকলেও এখন সরব হয়ে উঠেছে। দুই দলের নেতাদের পরস্পরের প্রতি বাক আক্রমণ এখনকার রাজনীতিতে কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ বলা যায় বিএনপির সঙ্গে জোট করেই সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে জামায়াত। শুধু তাই নয়, নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনও করেন জামায়াত নেতারা।
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে তাদের শীর্ষ দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদ মন্ত্রীও হন। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে দুজনকেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।
২০১৮ সালের আগে বিএনপির জোটে থাকলেও দাঁড়ি পাল্লা প্রতীকে ভোট করত জামায়াত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের আসন ছিল দুটি, তার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে তারা ১৭টি আসনে জয়ী হয়।
১৯৯৬ সালে এককভাবে নির্বাচন করে তিনটি আসনে জিতেছিল জামায়াত। তার আগে ১৯৯১ সালে বিএনপির সঙ্গে অপ্রকাশ্য আসন সমঝোতা করে জামায়াতের ১৮ জন গিয়েছিলেন সংসদে।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ১০টি আসন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগের ছাতায় প্রার্থী হয়েছিলেন জামায়াত নেতারা, জিতেছিলেন ৬টি আসনে।
জামায়াত সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে, ১২ শতাংশ। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট নেমে আসে প্রায় ৫ শতাংশে। ২০০১ সালে জোট হওয়ায় তাদের প্রার্থী ছিল কম, ভোটের হার ছিল ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০০৮ সালেরি নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট।
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ায় সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না।
যে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলে জামায়াত আগামী নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছে, সে আশায় গুঁড়ে বালি পড়বে বলে মনে মনে করেন বিএনপির নেতারা।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এনিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে বা সংসদ নির্বাচনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করেন না।
অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে এখন যুগপৎ আন্দোলনে নামা খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে তারা মনে করছেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, মানুষের আস্থা অর্জনে রাজনীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন, ডাকসু-জাকসু নির্বাচন সব দলের জন্যই একটা বার্তা দিয়েছে।
তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে জাতীয় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার কথা। তিনি দুই বার ডাকসুতে বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন। জাসদের নেতা হিসাবে তো বটেই, আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়েও সংসদ নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি কখনো।
ডাকসু নির্বাচনের ফল দেখার পর মান্না এক অনুষ্ঠানে বলেন, “ডাকসু নির্বাচন জাতীয় ভোটের প্রতিফলন নয়। আমি দুবার ডাকসুর ভিপি হয়েছি। খুব পপুলার ছিলাম ছাত্রদের মধ্যে। কিন্তু আমার পলিটিক্যাল পার্টি হয়নি। আমি তো ক্ষমতায় যাইনি। আমার পার্টি তো ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ডাকসুতে জিতলেই যে তারা জাতীয় রাজনীতিতে বিরাট কিছু করে ফেলবে, সেরকম নয়।”