বিভুরঞ্জন সরকারের কলম থেমে গেল চিরদিনের মতো; আর লিখবেন না তিনি। একদিন আগে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন এই সম্পাদক-কলামিস্ট। তার পরিবারের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন ছিল সাংবাদিক মহল-ভক্তকূল।
একদিন বাদে শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে মেঘনা নদীতে তার ভাসমান লাশ পাওয়া গেছে। দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কী কারণে মৃত্যু, তা নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্তের অপেক্ষায় পুলিশ থাকতে বললেও ধারণা করা হচ্ছে, প্রবীণ এই সাংবাদিক আত্মহত্যাই করেছেন।
এই ধারণায় ভিত্তি দিচ্ছে বিভুরঞ্জন সরকারেরই লেখা একটি খোলা চিঠি, যা তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে পাঠিয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশের জন্য। সেই সঙ্গে লিখেছিলেন, এটাই তার জীবনের শেষ লেখা।
এটি আত্মহত্যা ধরে নিলেও সেই চিঠি পড়ে সাংবাদিকদের অনেকেই বলছেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা পদ্ধতিগত খুনের নামান্তর। ‘বিভুদা’কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিভুরঞ্জনের এই চিঠি গোটা রাষ্ট্র-সরকারসহ অনেককেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেখানে উঠে এসেছে, কতটা নিরাপত্তাহূীন হয়ে উঠেছিল তার যাপিত জীবন, কতটা অপাঙক্তেয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
৭১ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে জীবনের পাঁচ দশকই সাংবাদিকতা করে কাটিয়েছিলেন তিনি। একটি দৈনিকের এবং একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ কাজ করছিলেন দৈনিক আজকের পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে।
বৃহস্পতিবার সকালে পত্রিকাটির অফিসে যাওয়ার উদ্দেশেই নিজের সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। নিজের মোবাইল ফোনটি ঘরে রেখে গিয়েছিলেন তিনি।
তাই তার খবর নিতে যখন পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল আজকের পত্রিকায়; তখন তারা জানতে পারেন, তিনি অফিসে যাননি। পরে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে থানায় জিডি করেন ছেলে ঋত সরকার।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে আজকের পত্রিকায় একটি কলাম প্রকাশ নিয়ে বিভুরঞ্জন সরকারকে চাপ দেওয়ার বিষয়টিও কারও কারও কথায় আসে।
বিভুরঞ্জন সরকারকে এক সপ্তাহের ছুটি দেওয়ার কথা আজকের কাগজ কর্তৃপক্ষ বললেও কেন তাকে ছুটিতে পাঠানো হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তবে বিভুরঞ্জন সরকারের খোলা চিঠিতে তার একটি ইঙ্গিত ছিল। একটি কলাম প্রকাশের জেরে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার কথা লিখে গেছেন তিনি।
“আমার একটি লেখার জন্য ‘আজকের পত্রিকা’র অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম বাবলার একটি লেখার জন্যও চোটপাট করা হয়েছে। আপত্তিকর কি লিখেছেন বাবলা? লিখেছেন, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে। আর শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে। এখানে অসত্য তথ্য কোথায়? শেখ হাসিনা কি হেলিকপ্টার ভাড়া করে গোপনে পালিয়েছেন? হাসিনার পুলিশ না হয় ছাত্র-জনতাকে হত্যা করলো, কিন্তু পুলিশ হত্যা করলো কে বা কারা? এইটুকু লেখার জন্য পত্রিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগা একেবারেই অনুচিৎ।”
“সব মিলিয়ে পত্রিকায় আমার অবস্থা তাই খুবই নাজুক। সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন। আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?” নিজের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে বিভুরঞ্জনের লেখায়।
এখানে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা, তাও স্পষ্ট হয়ে আসে। বিভুরঞ্জনের লাশ পাওয়ার দিনই সরকারের এক বিবৃতিতে বিচারের মুখে থাকার কারণে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার করা নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়।
তার আগের দিনই বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছিলেন, “গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা আরও কাহিল হয়েছে। মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু তার প্রেস বিভাগ তো মনখোলা নয়। মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন, তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!”
আওয়ামী লীগ আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখতে যা করা হত, অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বিশাল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলেও তার কিছুই বদলায়নি বলে মত আসছে অনেকেরই।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলে কোনো ধরনের সুবিধা না নিয়েও ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার চাপ নিয়ে চলতে হচ্ছিল বিভুরঞ্জন সরকারকে।
“শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।”
দুই সন্তান চিকিৎক ও প্রকৌশলী হলেও তার কারণেই যোগ্যতার মূল্যায়ন পায়নি বলে অভিযোগ করে গেছেন তিনি।
“আমার সংসারে স্ত্রী ছাড়া দুই সন্তান। এক মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেমেয়েরাও আমার মতো একটু বোকাসোকা। বর্তমান সময়ের সঙ্গে বেমানান। মেয়ে বড়। জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেনি। ডাক্তার হয়েছে। বিসিএস পাস করে চাকরিও পেয়েছে। গ্যাসট্রোএনটোরোলোজিতে এমডি করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে ধরা খেল। সরকার বদলের পর বিভাগীয় প্রধানের কোপানলে পড়ে আমার মেধাবী মেয়েটি থিসিস পরীক্ষায় অসফল হলো। অথচ ও কোনো রাজনীতির সাতে-পাঁচে নেই। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় অবশ্য পাস করেছে, এখন থিসিসের জন্য আবার অপেক্ষা। এর মধ্যে আবার কোন নিভৃত অঞ্চলে পোস্টিং দিয়ে দেবে, কে জানে!
“আমার ছেলেটি বুয়েট থেকে এমএমইতে পাস করেছে। আমেরিকায় একটি বৃত্তি পেয়েও শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে সময়মতো যেতে পারেনি। আমার ছেলেটি চার বছর বয়সে গুলেনবারি সিনডর্ম রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে কয়েক মাস পাঞ্জা লড়ে তবে বেঁচেছে। ওর ব্যয়বহুল চিকিৎসার ধকল আমি সয়েছি। বুয়েট পাস হয়ে দেশে কত চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পাস করেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ নিশ্চিত হলো না। অপরাধ কি ওর নাম, নাকি বাবা হিসেবে আমি, বুঝতে পারছি না।”
সাংবাদিক হিসাবে সৎ জীবন-যাপন করে প্রতিনিয়ত অর্থকষ্টের মধ্যে জীবন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে গেছেন বিভুরঞ্জন।
“আমি লিখি, কারণ আমি জানতাম সাংবাদিকতা মানে সাহস। সত্য প্রকাশ মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার নাম। দীর্ঘ পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সত্য লিখতে হলে কখনো কখনো ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য হারাতে হয়। আমি তেমন স্বাচ্ছন্দ্য চাইনি কখনো। তবে সারাজীবন হাত পেতে চলতে হবে এটাও চাইনি।”
বিভুরঞ্জন সরকারের জন্ম পঞ্চগড়ে, ১৯৫৪ সালে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা বিভাগে। ছাত্রজীবনে বাম আদর্শে ঝুঁকে পড়েন, যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নে, পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে। এই দলটির মুখপত্র একতায় কাজ করতেন তিনি।
পরে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এসে কাজ করেন দৈনিক সংবাদ, দৈনিক রূপালীতে। তবে সাংবাদিক হিসাবে তার প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে এসে। গত শতকের ৮০ এর দশকে যায়যায়দিনে তারিখ ইব্রাহিম নামে লেখা তার কলাম ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
পরে সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদক হন তিনি। এরপর নিজের সম্পাদক হয়ে বের করেন সাপ্তাহিক চলতিপত্র। পরে দৈনিক মাতৃভূমির সম্পাদকও হন তিনি। এছাড়া দেশের প্রায় সব পত্রিকায় নিয়মিতই প্রকাশ হত তার কলাম।
কিন্তু আর্থিক দৈন্য ঘোচেনি তার, যা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পেশাগত জীবনের আর্থিক অনিশ্চয়তা তুলে ধরে। শেষ বয়সে এসে কলাম পাঠালেও ঠিকমতো ছাপা হত না, আবার ছাপা হলেও টাকা পেতেন না, এমন অনুযোগও করে গেছেন বিভুরঞ্জন সরকার।
“দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইনে আমার লেখা একসময় নিয়মিত ছাপা হতো। দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’ যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন প্রথম পৃষ্ঠায় আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হতো। অথচ এখন কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ছাপার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাই না। আমার লেখা নাকি পাঠক আর সেভাবে ‘খায়’ না … আজ আমার লেখা নাকি পাঠক টানে না। হতেই পারে, বয়সের ভারে বুঝি লেখা হালকা হয়ে গেছে।
“নামে-বেনামে হাজার হাজার লেখা লিখেছি। সম্মানী কিন্তু পেয়েছি খুবই কম। কোনো কোনো পত্রিকা তো কয়েক বছর লেখার পরও একটা টাকা দেওয়ার গরজ বোধ করেনি। সেদিক থেকে অনলাইনগুলো অনেক ভালো। একটি বড় অনলাইনের কাছেও আমার মোটা টাকা এখনো পাওনা আছে।”
আর্থিক দৈন্যের কথা বারবার বললেও তা যে তার গোটা পেশাজীবনের সঙ্গী ছিল, সেকথা বিভুরঞ্জন সরকারের নিজের লেখাতেই এসেছে।
তাহলে কি আজকের পত্রিকা কর্তৃপক্ষের চাপ, যা অনেকটা সরকারের মাধ্যমেই এসেছে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে, সেটাই তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করেছে? এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, যদিও না আজকের পত্রিকা, না সরকার, কেউ এবিষয়ে কোনো কথা বলছে না।
আদর্শের প্রশ্নে ছাড় না দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি নিজেই লিখেছেন, “স্কুল ছাত্র থাকতেই সাংবাদিকতার পেশায় জড়িয়েছি। দৈনিক আজাদের মফস্বল সাংবাদিক। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের নামে আজাদে বড় বড় লেখা ছাপা হয়েছে। আবার বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াও সেই স্কুল থেকেই। রাজনৈতিক আদর্শবোধ ও সাংবাদিকতার নৈতিক সততা আমাকে ব্যক্তিগত সুখভোগের জন্য তাড়িত করেনি।
“একটাই তাড়না–দায়িত্ববোধ। আমি জ্ঞানত কখনো দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। নিজের কাজে ফাঁকি দেইনি। খুব সাহসী মানুষ হয়তো আমি নই, কিন্তু চোখ রাঙিয়ে কেউ আমাকে দিয়ে কিছু লেখাতে পারিনি।”
নিজের বেতন নিয়ে তিনি লিখেছেন, “এখন আমার যা বেতন, তা বলে কাউকে বিব্রত করতে চাই না। তবে শুনেছি, আমার বিভাগীয় প্রধানের বেতন আমার প্রায় দ্বিগুণ। আহা, যদি ওই বেতনের একটি চাকরি পেতাম তাহলেও হয়তো সংসার চালানোর জন্য নিয়মিত ধার-দেনা করার পেশাটি আমাকে বেছে নিতে হতো না!
“আজকের পত্রিকা’য় কাজ করছি ৪ বছর হলো। এই সময়ে না হলো পদোন্নতি, না বাড়ল বেতন। অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। সংবাদপত্র আর কীভাবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে, ঘরের মধ্যেই যেখানে অনিয়ম।”
বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ পাওয়ার পর আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছে, সাবেক এই সম্পাদক ২০২১ সালের ১০ মার্চ এই সংবাদপত্রে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন, ২০২২ সালের ১ জুলাই পদোন্নতি পেয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হন।