বাম তাত্ত্বিক, রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর মারা যাওয়ার পরদিন তার একটি জবানবন্দি প্রকাশ করলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে এই ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি শেখ হাসিনা। সেই মামলায় সাক্ষী হিসেবে এই জবানবন্দি দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, যার নানা বক্তব্য ঘিরে অতীতেও বিতর্ক তৈরি হতে দেখা গেছে।
উমর তাতে অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও বলে যান। তার ধারণা, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরার অবস্থায় নেই।
উমরের ভাষ্যে, “এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িতই হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়ত কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।”
যেদিন বদরুদ্দীন উমরের এই জবানবন্দি প্রকাশ পেল, ঠিক সেদিনই আওয়ামী লীগকে জাগিয়ে তুলতে শেখ হাসিনার একটি পরিকল্পনার খবর দিল বিবিসি বাংলা। দিল্লি থেকে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন শুভজ্যোতি ঘোষ।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার পর থেকে দিল্লিতে ভারত সরকারের আশ্রয়েই রয়েছেন শেখ হাসিনা। সেখানে বসেই তিনি দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন, এমনটাই বলছেন সাংবাদিক শুভজ্যোতি।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই মাঝে-মধ্যে এই প্রশ্ন উঠছিল- তারপর আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন? জয় না কি পুতুল, সেই প্রশ্নও ছিল। শেখ হাসিনা বরাবরই তা এড়িয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা জয় রংপুরে আওয়ামী লীগের সদস ফরম পূরণ করলেও রাজনীতিতে সক্রিয় হননি কখনও; যদিও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে সরকারি পদ নিয়েছিলেন। পুতুল কখনও আওয়ামী লীগে সক্রিয় হননি। তার মনোযোগ ছিল অটিজম সচেতনতা গড়ার দিকে, শেষ অবধি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালকও হন তিনি।
সন্তানদের রাজনীতিতে আনার বিষয়ে শেখ হাসিনাকে কখনও তেমন আগ্রহী দেখা যায়নি। তিনি বলতেন, জয়-পুতুল রাজনীতিতে নামবেন কি না, সেটা তাদের ওপরই নির্ভর করে।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটা বদলে গেছে। ৭৬ বছরেরও বেশি পুরনো আওয়ামী লীগ এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটে। অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পোড়ে দলের সব অফিস, নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটিও অক্ষত নেই। দলের নেতারা কেউ এখন বিদেশে পালিয়ে কিংবা কারাগারে। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ নামে যে কোনো কাজের ওপরও দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় এমনই এক সঙ্কটকালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর দেশে ফিরে দলের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিতে না থেকেও পরিস্থিতির প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে টানা ৪৪ বছর সেই পদে তিনি। এবারও কঠিন সময়ে এসে ৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনা নিজের পরিবারের হাতেই নেতৃত্ব তুলে দিতে চাইছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।
দিল্লিতে ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে থাকা শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রয়েছে। তবে কয়েকজন নেতা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাদের বরাতেই বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। পাশাপাশি এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিরও।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা জয় মায়ের পর দলের প্রধান মুখপাত্র হিসেবে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।
পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতেই রয়েছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আপত্তির মুখে তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে রেখেছে বিশ্ব সংস্থাটি। ফলে এই অবসরে পুতুল অনলাইনে মায়ের দেওয়া ভাষণের খসড়া তৈরিতে, কর্মসূচির ক্যালেন্ডার স্থির করতে সাহায্য করছেন।
এমনকি বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি দেখা করার ক্ষেত্রে যেহেতু অনেক বিধি-নিষেধ রয়েছে, তাই সে কাজটি এখন অনেকাংশেই পুতুলের ওপর বর্তেছে। গত দু’মাসে তিনি বেশ কয়েকবার এরকম বৈঠকও করেছেন।
গত মাস থেকে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে রাজনৈতিক পোস্টও দিতে শুরু করেছেন পুতুল। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দায়িত্ব পালনকালে তা থেকে বিরত ছিলেন তিনি।
তবে দেশে শেখ হাসিনা যেমন বিচারের মুখোমুখি, তেমনি প্লট দুর্নীতির অভিযোগে জয় ও পুতুল উভয়ের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। মামলা হয়েছে ববি এবং তার মা ও বোনদের বিরুদ্ধেও।
রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল?
ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে বিশেষ করে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে গভীর। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে গিয়েও গান্ধী পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা না করে ফিরতেন না।
দলের নেতৃত্বে উত্তরাধিকার আনার ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা কংগ্রেসের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইছেন বলে দলীয় সূত্রগুলো বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে।
বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য সোনিয়া গান্ধী যতই সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই সরে গেছেন। সেখানে কংগ্রেসের হাল ধরেছেন তার ছেলে-মেয়ে রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
দলের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, সংবাদ সম্মেলন সবকিছুতেই এখন কংগ্রেসের মুখ রাহুল। প্রিয়াঙ্কা রয়েছেন ভাইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীর ভূমিকায়। তবে বড় ভাইকে কখনও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি। পেছনে থেকে রাহুলকে সামনে ঠেলে দিচ্ছেন তিনি।
রাহুলকে একেবারে সামনে রেখে এবং প্রিয়াঙ্কাকে ঠিক তার পেছনে রেখে যেভাবে কংগ্রেস পরিচালিত হচ্ছে, শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগকে সেভাবে চালাতে চাইছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছে।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে তাদের সশরীরে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে আপাতত তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা এবং পরিকল্পনা সাজানোর কাজটি করছেন পুতুল। অন্যদিকে জয়ের নেতৃত্বে আমেরিকায় আর একটি দল কাজ করছে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি এবং বিদেশে তার প্রচারে।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করলেও ‘স্পর্শকাতর বিষয়’ বলে তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত দাবি করছেন, এ নিয়ে দলের ভেতরে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সত্যি কথা বলতে, আপনি যে সাকসেসন প্ল্যানের কথা বলছেন, সেটা এখন আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে না। কে কী পদ-পদবী পেলেন, সেটা এখন ভাবারই সময় নয়। আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, সেই লক্ষ্যেই সব চেষ্টা নিয়োজিত করা হচ্ছে।”
তবে শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যরাও যে এই কাজটিতে কাঁধ মিলিয়েছেন, তা স্বীকার করেন তিনি।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: