থরে থরে টাকা, তা গুনছে শয়ে শয়ে মানুষ। গুনতে গুনতে টাকার মধ্যে মিলছে কিছু চিঠি, চিরকূট ধরনের। তা পড়ে হাসির রোল পড়ে।
বলছি কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের কথা। এই মসজিদের দানের সিন্দুক বা দান বাক্স খুলে বস্তা বস্তা টাকা গোনার কথা প্রতিবারই খবরের শিরোনাম হয়। তবে টাকার ফাঁকে ফাঁকে অনেক চিঠিও পড়ে এই দান বাক্সে।
৪ মাস ১২ দিন পর শনিবার দান বাক্সে ২৮ বস্তা টাকার পাশাপাশি এক বস্তা চিঠিও পাওয়া গেছে। সেগুলো নানাজনের ইচ্ছাপূরণের আকুতিতে ভরপুর। দান বাক্স খোলার পর এই চিঠিগুলোর খবর দিয়েছে প্রথম আলো।
কেউ ভালোবাসা পেতে পাগলা বাবার দোয়া চেয়েছেন, কেউ দোয়া চেয়েছেন বিয়ের জন্য, কেউবা সন্তানের জন্য। রাষ্ট্রক্ষমতায় পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে চেয়েও চিঠি জমা পড়েছে এই দান বাক্সে।
তাতে বোঝা যাচ্ছে, এই যুগে এসেও দোয়ার বরকতে প্রাপ্তিযোগের আশায় থাকা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

একটি চিঠিতে এক তরুণ তার মানসীর নাম উল্লেখ করে চিঠিতে লিখেছেন, “ইয়া পাগলা বাবা, আমাদের সালাম গ্রহণ করবেন। আমাদের আরজি কবুল করুন। আমাদের মনের বাসনা আপনি বোঝেন। …. ভালোবাসে ……কে। তার পরিবার বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি না। আপনি তাকে এনে দেন।”
আরেকজন লিখেছেন, “আমি খুব অসহায়। আমার বিয়ে বারবার ভেঙে যাচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে নিয়ে চিন্তিত। চারপাশের মানুষের কটূ কথা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি জানো আমি নির্দোষ ও নিরপরাধ। আমার বিয়েতে যদি কোনো বাধা-বিপত্তি থাকলে তুমি সমাধান করে দাও।”
এক নারী সন্তান কামনা করে লিখেছেন, “আমার বিয়ে হয়েছে ১২ বছর চলতাছে। কিন্তু এখনো আমি কোনো সন্তানের মা হতে পারলাম না। অনেক ডাক্তার দেখাইছি, কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। আমি এমন কোনো দিন নাই, এমন কোনো রাত নাই, আমার আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদি নাই…আমাকে একটা নেক সন্তানের মা হওয়ার সুযোগ দেন।”
অর্থ সঙ্গতি বাড়ার আকাঙ্ক্ষায় একজন লিখেছেন, “আল্লাহ তুমি ওষুধের ব্যবসা দিয়ে ব্যাংকে ১১ লাখ টাকা জমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ আপনার কাছে আবদার, ২০২৬ সালে যেন ব্যাংকে ২৬ লাখ টাকা জমা হয়ে যায়।”
নামে-বেনামে এমন সব চিঠির ভিড়ে একটি চিঠিতে লেখা ছিল- “পাগলা চাচা, শেখ হাসিনা কোথায়?”
আরেক চিঠির বক্তব্য ছিল- “ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই। আল্লাহ তুমি সহজ করে দাও।”

মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবারই সিন্দুক খোলার সময় অনেক চিঠি বা চিরকূট পাওয়া যায়। তবে এবার সংখ্যাটি বেশি।
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ একটি । শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় চার একর জমির ওপর সুউচ্চ মিনার ও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট তিনতলা এই মসজিদ।
কথিত আছে, প্রায় পাঁচশ বছর আগে বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারদের অন্যতম ঈশা খাঁর আমলে দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামে এক ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরে ওই স্থানটিতে মসজিদটি নির্মিত হয়। তার নামেই মসজিদটির নামকরণ হয় ‘পাগলা মসজিদ’।
অনেকের বিশ্বাস, এ মসজিদে দান করলে মানুষের মনের আশা পূরণ হয়। সে জন্য দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে দান করে।
টাকা-পয়সা ছাড়াও স্বর্ণালংকার দান করেন অনেকে। এছাড়া গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও মসজিদটিতে দান করা হয়।
এই মসজিদে মোট ১১টি সিন্দুক আছে এখন। কিন্তু চিঠির কারণে টাকার জায়গায় সমস্যা হচ্ছে বলে এই ধরনের চিঠি না ফেলার অনুরোধ করছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ।
দানের রেকর্ড
পাগলা মসজিদের দান বাক্স খোলা হয় প্রশাসনের তদারকিতে। দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক এখন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, এবার ১১টি সিন্দুকে মোট ২৮ বস্তা টাকা, এক বস্তা চিরকুট, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া গেছে।

এবার টাকার পরিমাণ বেশি দেখে গণনাকারীও বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে ৪৯৪ জন দিনভর টাকা গণনা করেন।
এরপর সন্ধ্যায় পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জানান, এবার রেকর্ড ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
এর আগে গত বছরের ৩০ নভেম্বর মসজিদের ১০টি দানবাক্স থেকে সর্বোচ্চ ৮ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৪ টাকা পাওয়া গিয়েছিল।
পাগলা মসজিদ মাদরাসা ও আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মোট ২৮৬ জন ছাত্র এবং রূপালী ব্যাংকের ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে মোট ৩৬৬ জন টাকা ভাঁজ ও গণনার কাজ করেন। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও আনসারের ৭৫ জন সদস্য ছাড়াও মসজিদ-মাদ্রাসার ৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের সহায়তা করেন। টাকা গণনার কাজ তদারকি করেন ১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
নগদ টাকা গণনা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনা-রুপার গয়নার হিসাব পরে করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া।
এছাড়াও পাগলা মসজিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিভিন্নজনের দান থেকে পাওয়া ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ টাকা জমা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
দানের টাকা থেকে পাগলা মসজিদ ও এর অন্তর্ভুক্ত মাদ্রাসা, এতিমখানা ও গোরস্থানের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এছাড়া দানের টাকায় জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় সহায়তার পাশাপাশি গরিব ছাত্র ও দুস্থদের আর্থিক সহায়তা করা হয়।