চার দিনের আগুনে লস অ্যাঞ্জেলেস রীতিমত ভষ্ম হয়ে গেছে; আমার বাড়িটার আর অস্তিত্ব নেই; জ্বলন্ত অঙ্গারের স্তূপে পরিণত হয়েছে গোটা কাঠামো ।
মঙ্গলবার সকালে যেখানে প্রথম আগুনের সূত্রপাত সেখান থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে প্যালিসেডসে ছিল আমার বাড়ি। এখন শহরের উত্তরে লা ক্রিসেন্টায় এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি।
ভেবেছিলাম এখানে অন্তত নিরাপদ! কিন্তু শহর জুড়ে এখনও ছয়টি জায়গায় আগুনের লেলিহান শিখা। এখন আর কোথাও নিরাপদ বোধ করছি না। আমিসহ ১ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি লোককে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
আমার মতো অনেকেই পালিয়ে ভেবেছিল তাদের হয়তো আর জায়গা পরিবর্তন করতে হবে না; কিন্ত কে জানতো, আবারও ছুটতে হয়েছে আগুনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
ব্যাগগুলো দরজার কাছেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, কখন না আবার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো অ্যালার্ম বেজে উঠলো।
বৃহস্পতিবার বিকেলে যে ভয়ে ছিলাম কখন আবার অ্যালার্ম বেজে ওঠে, তা যে এত দ্রুত বাস্তব হয়ে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।
আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে গাড়ির কাছে ছুটে গেলাম। বুঝতে চাইলাম গাড়িতে পর্যাপ্ত গ্যাস আছে কিনা; গ্যাস প্রায় শেষ। আমার সঙ্গীকে একটা উপায় বের করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। চারটি স্টেশন ঘুরে অবশেষে সে গ্যাস পেল। অথচ বাস্তবতা হলো ওই অ্যালার্ম বেজে ওঠেছিল ভুলবশত; এটা মানা যায়?
একজন জলবায়ু বিষয়ক সাংবাদিক হিসেবে, বিরূপ আবহাওয়ায়ও বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করতে আমি মোটামুটি অভ্যস্ত। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মালিবুর আগুন থেকে পালিয়ে আসা বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আজ আমি নিজেই নিজের গল্প বলছি।
প্যালিসেডস আগুনকে ইতিমধ্যেই একটি ঐতিহাসিক দাবানল বলা হয়েছে। এবং এই স্মৃতি চিরকাল আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। আমার প্রতিবেশী, আমার ঘরবাড়ি, এই দাবানল কেড়ে নিয়েছে।
৭ জানুয়ারি সকালে যখন প্রথম আগুনের সূত্রপাত তখনও কিন্তু সেটি প্যালিসেডস গ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছিলো। আমি সান্তা মনিকা পাহাড়ের ধারে ছোট ছোট আগুনের কুণ্ডলি দেখতে পাচ্ছিলাম। নীল আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো কালো ধোঁয়া। স্থানীয়রা সেই ছবি তুলছিলো।
এক ঘণ্টা পর, আগুনের লেলিহান শিখা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে। দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে আগুন ঘরবাড়ি গ্রাস করতে শুরু করেছে, আকাশে উড়ছে ধোঁয়া।
দুই দিন আগেই সান্তা আনার বাতাসের সতর্কতা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম, ঘণ্টায় ১২৯ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিলো। এই বাতাসের বেগ এবং উষ্ণতাই আগুন দ্রুত এবং তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য ভূমিকা রেখেছে বলে আমার ধারণা।
আমি বুঝতে পারছিলাম যে বাতাস কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে; শহর জুড়ে জ্বলন্ত অঙ্গার এবং ধোঁয়া উড়ছে। আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দাবানল ঘিরে ধরলো পুরো এলাকা।
সত্যিই ভয়াবহ ছিল সে দৃশ্য। একটা উজ্জ্বল লাল সূর্য আমাদের উপর কমলা রঙের আভা ফেলছিল, আর ছাইগুলো উড়ছিল যেন তুষারপাতের মতো।
আমি দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসি। ভাবতে থাকি এখান থেকে যে করেই হোক সরে যেতে হবে। বুঝতে পারলাম, ওই মুহূর্তে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ একমাত্র রাস্তা ‘সানসেট ব্লাভডে’ তখন প্রচণ্ড মাত্রার জ্যাম।
প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র- পাসপোর্ট, জন্ম সনদপত্র গুছিয়ে নিলাম, এবং এরপর যখন মনে হলো আরও কিছুটা সময় আছে, তখন বাড়ির সামনের উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
অবশেষে যখন বলা হল যে পুরো প্যালিসেডের বাসিন্দাদের বাধ্যতামূলকভাবে সরে যেতে হবে তখন আমিও আর থাকার সাহস করলাম না। আগুন আমার বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো ততক্ষণে।
আশ্চার্য্যজনক হলেও সত্যি, ভয়াবহ সেই দিনটিতে আমাদেরকে সরে যাওয়ার বিষয়ে বা আগুন লাগার বিষয়ে কোনো সতর্কতা আমার কাছে আসেনি। এমনকি আমার সঙ্গীও পায়নি। যতটুকু জেনেছি প্রতিবেশীদের মাধ্যমে, তারাই আমাদের জানিয়েছিল।

সত্যি বলতে আমি ভাগ্যবান যে আমার কাছে একটি ‘প্রেস পাস’ ছিল এবং আমি জরুরি পরিষেবা কেন্দ্রের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করে খবর জানতে পেরেছি। সবচেয়ে বড় বিষয়, আমার পরিচিত সবাই বেরিয়ে আসতে পেরেছিলো। যোগাযোগ এবং তথ্যের অভাবে আমাদের অনেকেই শুরুতে বুঝতে পারিনি যে আগুন আমাদের বাড়ির কতটা কাছে।
অবশ্য বের হতে আমাদের কিছুটা সময় লেগেছিলো। কারণ রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি, কে কার আগে যাবে এই নিয়ে সবাই মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। হতাশা ও ভয় স্পষ্ট ছিল চোখেমুখে।
ভেবেছিলাম অন্তত আমার বাড়িটা নিরাপদ থাকবে কারণ এটির অবস্থান পাহাড়ের বিপরীতে ‘সানসেট ব্লাভডির’ অন্য পাশে। ভাবিনি আগুন এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার করে চলে আসবে!
যখন এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পেলাম প্যালিসেডস হাই স্কুলে আগুন জ্বলতে দেখেছে, তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আগুন ধারণার চেয়েও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। আমি খবর দেখছিলাম। চোখ ফেরানোই কঠিন ছিল তখন। স্কুলে আগুন জ্বলতে দেখে হৃদয়ে মোচড় দিয়ে উঠলো, পুড়ে গেল আমাদের স্থানীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
এটা জানা ছিলো, রাত নামার সাথে সাথে বাতাসের গতি বাড়বে এবং অন্ধকারে আগুন নেভানো অনেক কঠিন হবে। বুঝতে বাকি রইল না নিজের বাড়িটি হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না; বিষণ্নতা ঘিরে ধরলো। মনে মনে নিজেকে গৃহহীন ভাবতে শুরু করেছিলাম নিজের অজান্তে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আমরা লা ক্রিসেন্টা পৌঁছালাম। পরের দিন সকালে একজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে খবর পেলাম যে রাতের মধ্যে আমাদের ওখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। স্বস্তিতে কেঁদেই ফেললাম।
এর মাঝেই প্যালিসেডসে লুটপাটের ঘটনা সম্পর্কেও জানতে পারলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক আমাদের ফিরতে হবে, আমাদের ফেলে আসা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ছবি, জার্নাল এবং পারিবারিক গয়না- এসব উদ্ধার করতে হবে।
বুধবার বিকেলে ফিরে আসি এবং আমার ‘প্রেস পাসের’ কারণে গাড়ি চালিয়ে ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি। আমরা যখন ‘সানসেট ব্লাভডে’ পৌঁছাই, তখন আমাদের বাড়ির ব্লকের সামনে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি থেমে আছে। হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছিলো যেন।
আমরা গাড়ি চালিয়ে পাশ কাটিয়ে গেলাম এবং দেখলাম আমাদের পুরো বাড়ি ভষ্ম হয়ে গেছে।
গাড়িটা পার্ক করে পেছনের দিকে দৌড়ে গেলাম। যেখানে প্রায় ২০টি বাসা একসময় দাঁড়িয়ে ছিল সেটি জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত। মুখে ছাইয়ে মাখা অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা আমার বাড়িটা রক্ষা করতে না পরার জন্য দু:খ প্রকাশ করছিলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের ধন্যবাদ জানালাম।
আমাকে ফোন করে আমার সমস্ত প্রতিবেশীদের জানাতে হয়েছিল যে তাদের বাড়িঘর বলতে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না, যেন আমি বোবা হয়ে গিয়েছি।
আমার গ্রামের বেশিরভাগ অংশ, আমি বলব প্রায় ৯০ শতাংশ মাটিতে মিশে গিয়েছে। সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। আমি সেই ধাক্কা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং আমার প্রতিবেশীরা যা কিছু হারিয়েছে তা দেখে স্তব্ধ।
এখন শহর ছেড়ে আরও উত্তরে বন্ধুদের সাথে থাকার কথা ভাবছি, অন্তত যেখানে নিরাপদ থাকবো এবং ধোঁয়া থাকবে না। আমার মনে হয় লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে আসতে আমার আরও কিছু সময় লাগবে।
আর তাছাড়া যাবই বা কোথায়? বাড়ি নেই, লাইব্রেরি নেই, দোকান নেই, বাচ্চাদের কারাতে ডোজো নেই, থিয়েটার নেই, কমিউনিটি সেন্টার নেই। সবকিছুই তো শেষ হয়ে গেছে। এখন আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে কেন যে আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গেলাম না। যেমন ৩০তম জন্মদিনে বোনদের কাছ থেকে পাওয়া কানের দুল, সেই আমেরিকান আদিবাসীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার! অবশিষ্ট রয়ে গেল কিছু ভষ্ম।
মূল লেখাটি রিপোর্টারের ডায়েরি আকারে প্রকাশ করেছে বিবিসি, লিখেছেন লাকি শেরিফ।