শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘রাজনৈতিক বিচারে’ বাংলাদেশে গণমাধ্যমে চলছে ‘নির্বিচারে’ ছাঁটাই। বাদ পড়েনি সম্পাদক থেকে নিম্ন পর্যায়ের সাংবাদিকরা। হয়েছে খুন, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে মামলা।
অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ছাঁটাইকৃতদের চেয়ারে যাদের বসানো হচ্ছে তারাও কোনো ‘বিশেষ’ রাজনৈতিক দলের অনুসারী অথবা সুবিধাভোগী।
দ্য সান ২৪ অনুসন্ধান করে এমন একটি তালিকা তৈরি করেছে যেখানে বাদ পড়াদের পাশাপাশি তাদের চেয়ারে বসানো সাংবাদিকদের পরিচয়ও উঠে এসেছে।
অবশ্য কয়েকটি টেলিভিশন, দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় তেমন কোনো ছাঁটাই নেই কিংবা দখলের তৎপরতারও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চাকরিচ্যুতির প্রথম ঘটনাটি ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখপত্র হয়ে দাঁড়ানো বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন একাত্তর টেলিভিশনে। ৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ ও প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সম্পর্কে শাকিল ও ফারজানা স্বামী-স্ত্রী, ফ্রান্সে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন তারা।
শাকিলকে সরিয়ে তার পদ এবং এর অতিরিক্ত হিসেবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় একই টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শফিক আহমেদকে, যিনি বিএনপির বিভিন্ন সংবাদ তৈরি করতেন, খানিকটা ‘বিএনপি ঘেষা’ বলেও কথিত রয়েছে।
ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান মামুন আবদুল্লাহকে সরিয়ে তার জায়গায় বসানো হয়েছে আকমল হোসেনকে।
ডিবিসি নিউজ টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টুকে সরিয়ে দিয়ে বসানো হয়েছে লোটন আকরামকে, যিনি এর আগে সমকালের সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় বিএনপির সংবাদ ‘কভার’ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, জায়েদুল আহসান পিন্টু ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের’ মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। একাধারে শিক্ষক এবং গবেষক হিসেবেও পিন্টুর রয়েছে নামডাক। লিখেছেন ‘রহস্যময় গণঅভ্যুত্থান’, ‘রক্তপিচ্ছিল অন্ধকার’ এর মতো একাধিক বই। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র শাসনে এসে কীভাবে ‘স্বাধীনতার পক্ষের সেনা সদস্যদের হত্যা করেছিলেন’ তা নিয়েও করেছেন গবেষণা।
সময় টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী পদ থেকে আহমেদ জোবায়েরকে অব্যাহতি দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে শম্পা রহমানকে।
এরই মধ্যে একই টেলিভিশনের পাঁচ গণমাধ্যমকর্মীর একসঙ্গে চাকরি যাওয়ার ঘটনায় উঠে এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর নাম। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে হাসনাতের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতাকর্মী ওই টিভির বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে দেখা করার পর ওই পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এটিএন নিউজের বার্তা প্রধান প্রভাষ আমিনকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মো. মোশাররফ হোসেনকে।
একই মালিকের আরেক টেলিভিশন স্টেশন এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যিনি ২০১৫ সাল থেকে ওই দায়িত্বে ছিলেন।
সরিয়ে দেওয়া হয়েছে নিউজ টোয়েন্টিফোর টিভির বার্তা প্রধান রাহুল রাহাকে।
বৈশাখী টিভির বার্তা প্রধান অশোক চৌধুরীকে অব্যাহতি দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জিয়াউল কবির সুমনকে, যিনি এর আগে ‘জামায়াত ঘেষা’ দিগন্ত টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক ছিলেন।
একুশে টেলিভিশনের বার্তা প্রধান রাশেদ চৌধুরীকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে হারুন উর রশীদকে।
নাগরিক টিভির বার্তা প্রধান দীপ আজাদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব।
এশিয়ান টিভির বার্তা প্রধান বেলাল হোসেনকে ছাঁটাই করে সেখানে বসানো হয়েছে সাংবাদিক সিরাজুল ইসলামকে, যিনি এর আগে চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন ও রেডিও তেহরানে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দৈনিক পত্রিকার মধ্যে যুগান্তরের সম্পাদকের দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সাইফুল আলমকে, যিনি পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সাইফুল ইসলামকে সরিয়ে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক করা হয়েছে কবি আবদুল হাই শিকদারকে, যিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
দৈনিক সমকালের সম্পাদক আলমগীর হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আলমগীর হোসেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি।
দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়েছেন পত্রিকাটির প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ (এ কে আজাদ। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন আজাদ। নৌকা প্রতীক না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বসুন্ধরার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের ডিরেক্টর হয়েছেন কাদের গণি। এই গ্রুপের কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান, বাংলানিউজ ২৪, নিউজ ২৪, টি স্পোর্টস ও ক্যাপিটাল রেডিও রয়েছে।
দৈনিক কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাসান হাফিজকে, যিনি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতিও হয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজামকে সরিয়ে দিয়ে পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহেরকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করা হয়েছে।
রঙধনু গ্রুপের মালিকানাধীন ‘প্রতিদিনের বাংলাদেশ’ এর সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়েছে মুস্তাফিজ শফিকে। গত ৩১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পত্রিকাটিতে শেষ অফিস করেন তিনি। এরপর পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন মোরছালীন বাবলা।
দৈনিক দেশরূপান্তরের সম্পাদক মুস্তফা মামুনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কামাল উদ্দিন সবুজকে সম্পাদক করা হয়েছে।
ডেইলি নিউজে সাংবাদিকতা শুরু করা কামাল উদ্দিন সবুজ পরবর্তীতে কাজ করেন বার্তা সংস্থা ইউএনবি ও বাসসে। সর্বশেষ তিনি বাসসের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক ছিলেন।
কামাল উদ্দিন সবুজ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।
দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক অরুণ কুমার দে’কে সরিয়ে সেই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলমকে।
দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর শেখ হাফিজুর রহমান।
বাংলানিউজ২৪ ডটকম এর সম্পাদক জুয়েল মাজাহারকে সরিয়ে সেখান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে লুৎফর রহমান হিমেলকে।
দ্য সান ২৪ এর এই প্রতিবেদক কথা বলেছে চাকরিচ্যুত বেশিরভাগ সাংবাদিকের সঙ্গে। বেশিরভাগই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নাম প্রকাশ করে কথা বলতেও রাজি নন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি টেলিভিশন স্টেশনের চাকুরিচ্যুত বার্তা প্রধান বলেন, “৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সমিতি, বাজার, ফুটপাত যেভাবে দখল হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় গণমাধ্যমগুলো দখল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের দোসর অ্যাখ্যা দিয়ে ছাঁটাইয়ের জন্য মালিকদের উপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে।
“মালিক প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে আমাকে অব্যাহতি নিতে অনুরোধ করেন। আমি কোনো কথা না বলে পদত্যাগ করেছি,” যোগ করেন তিনি।
কেন প্রতিবাদ করলেন না, জানতে চাইলে ওই সাংবাদিক বলেন, “কোথাও কোনো নিয়ম-কানুন মানা হচ্ছে না। বরং প্রতিবাদ করলে প্রাণ সঙ্কটের শঙ্কায় পড়ে যাবো। এখন চাকরি গেছে কিন্তু প্রাণে তো বেঁচে আছি!”
আরেকটি টেলিভিশনের বার্তা প্রধানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে পদত্যাগ করতে বলা হলে আমি কারণ জানতে চেয়েছিলাম মালিক পক্ষের কাছে। তখন জানানো হয়, আমার বিরুদ্ধে নাকি অনেক অভিযোগ। বলেছিলাম, দুর্নীতির অভিযোগ করতে। কিন্তু মালিকপক্ষ অনুরোধ করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন, তাই আপনাকে রাখা যাবে না, বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসছে।”
সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনের এই সাংবাদিককে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রায়ই দেখা যেত; কখনও কখনও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্নও করেছেন তিনি।
গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন, এতো সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুধু বার্তা প্রধান নয়, অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেও ছাঁটাই করা হয়েছে।
অবশ্য সাংবাদিক নেতা বা সংগঠনগুলোকে এখনও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়নি।
একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘ধরে নিলাম একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন। কিন্তু ওই টেলিভিশনের মালিকও দালালি করেছেন, তা কে তো গ্রেপ্তার করা হয়নি!”
লেখক ও সাংবাদিক আরিফ জেবতিক বলেন, “বর্তমানে সাংবাদিক সমাজের উপর ক্র্যাকডাউন চলছে। মানুষের বাক স্বাধীনতার উপর এতো বড় আঘাত বাংলাদেশে আগে কেউ করেনি। একাত্তর সালেও এমনটি হয়নি কিংবা এরশাদের সময়েও এতোটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।”
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বেশ আলোচিত, যিনি সঠিক তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনাকে বিশ্লেষণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তার বিভিন্ন কাজে।
সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করে সরকার পক্ষের চিহ্নিত লোকদের বসানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন জেবতিক।
তিনি বলেন, “এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে থাকবে। যারা ভাবছেন এটি ভালো কাজ হচ্ছে মনে রাখবেন ইতিহাস একদিন এই ঘটনার বিচার করবে।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাংবাদিকতায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি মশিউর রহমান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এক দলের পরিবর্তে আরেক দলের লোক এসেছে৷ সাংবাদিকতার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেই সব জায়গায় যোগ্য লোকটিকে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে তেমনটিও আমরা দেখিনি৷ ফলে ইতিবাচক চেষ্টা যে হচ্ছে, সেটাও বলা যাচ্ছে না।”
“আগে যে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খবরদারি করা হতো, এখন সেটা হচ্ছে না৷ কিন্তু আমরা ক্ষমতাধরদের তুষ্ট করার এক ধরনের প্রবণতা দেখছি,” যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরীর মতে ‘প্রটোকল নিউজ’ এখনো বন্ধ হয়নি।
তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেছিলেন, “সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে৷ গত দুই সপ্তাহ গণমাধ্যম দেখলে মনে হচ্ছে, তারা এক ধরনের অদৃশ্য চাপে আছে৷ অনেক সংবাদ হয়ত তারা ছাপছে, কিন্তু টোনটা শব্দচয়নে মাইল্ড করে দিচ্ছে৷ ওয়ান ইলেভেনে এক ধরনের চাপ ছিল, তখন আমরা এই ধরনের সাংবাদিকতা দেখেছি৷ আরেকটা বিষয় হলো মব জাস্টিস৷ এটা নিয়েও ভয়ের মধ্যে আছে মিডিয়া।”