অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মবের দৌরাত্ম্যের মধ্যে উত্থান ঘটেছে ‘তৌহিদী জনতা’র। এই ব্যানারে বিভিন্ন স্থানে মূলত নারীদের ওপরই আক্রমণ হচ্ছে।
সর্বশেষ ঘটনায় নারীর পোশাক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তাকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তারের পর তাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় ‘তৌহিদী জনতা’র তৎপরতা দেখা যায়।
তার কয়েকদিন আগে ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে বসে ধূমপানরত দুই তরুণীকে হেনস্তা করা হয়।
ইসলামকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নারীদের বাইরে বের হওয়া, নারী ফুটবলারদের খেলার বিরোধিতা, অভিনেত্রী-শিল্পীদের বাধা দেওয়ার ঘটনা একের পর এক ঘটে যাচ্ছে বাংলাদেশে।

তৌহিদী জনতা ব্যানারে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভে মূলত ছিল ইসলামী সংগঠনগুলো।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার শঙ্কা জেগেছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সেই শঙ্কার ভিত্তি দিচ্ছে।
অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে কারাগার ভেঙে ৭৯ জঙ্গি পালিয়ে যায়। পাশাপাশি উগ্রবাদী ইসলামী সংগঠনগুলোও প্রকাশ্য হয়। নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরও এখন কর্মসূচি পালনে নেমেছে।
নারী অধিকারের বিরোধিতা করা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে এখন ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে নারী হেনস্তার ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ।
একের পর এক ঘটনা
নারীর সমান অধিকারে বরাবরই আপত্তি তুলে আসছে ইসলামী সংগঠনগুেলা। নারী উন্নয়ন নীতি ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে ২০১৩ সালে উত্থান ঘটে গণজাগরণবিরোধী হেফাজতে ইসলামের।
শেখ হাসিনার শাসনকালে চাপে থাকা ইসলামী সংগঠনগুলো এখন খোলস ছেড়ে বের হচ্ছে। ইসলামিবিরোধী কিছু করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিচ্ছে।
গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানের পরপরই ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে বিভিন্ন মাজার ভাঙা হতে থাকে, সেই সঙেহ চলে নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পণ্ড করা।
হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি প্রসাধন কোম্পানির বিক্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন করতে যেতে পারেননি চিত্রনায়িকা পরীমনি। তৌহিদী জনতার বাধার মুখে চট্টগ্রামে পড়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীও। ঢাকার কেরানীগঞ্জে একই বাধার মুখে পড়েন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস।
এরপর ‘তৌহিদী জনতা’র লক্ষ্যবস্তু হয় দেশের নারী ফুটবল। তাদের দাবির মুখে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিতে হয় প্রশাসনকে। নারী ফুটবলের আয়োজকদের ওপর হামলাও হয়।
গত ১ মার্চ ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে প্রকাশ্যে ধূমপানের অজুহাত তুলে তর্কাতর্কির পর দুই তরুণীকে হেনস্তা করা হয়।
সর্বশেষ গত বুধবার ওড়না না পরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে মোস্তফা আসিফ অর্ণব নামে এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হলে তাকে উদ্ধারে নামে ‘তৌহিদী জনতা’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীকে হেনস্তাকারীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে।
রাতভর শাহবাগ থানায় অবস্থান নিয়ে তার মুক্তির দাবি জানানোর পর আদালত থেকে জামিনে তাকে ছাড়িয়ে এনে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তাকে। আদালতে তাকে নিয়ে উল্লাস করে তারা জানায়, ইসলামের বিরুদ্ধে কোনও আঘাত এলে তারা জীবন দিতেও পেছপা হবেন না।
তৌহিদা জনতার পেছনে কারা?
ঢাকার বাইরের কয়েকটি ঘটনা যাচাই করে বিবিসি বাংলা দেখেছে, তৌহিদী জনতা ব্যানারে যারা জড়ো হচ্ছে, তারা ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত অথবা ইসলামী রাজনীতির সমর্থক।
মিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল আয়োজন ঠেকাতে যারা নেমেছিল, তাদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীই বেশি ছিল বলে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে এই মব চললেও ইসলামী পণ্ডিতরা তা সমর্থন করছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তারা যা করছে, ইসলাম, রাষ্ট্র বা আইন তাদেরকে সেই অনুমতি দেয় না।”
একই মত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “ইসলাম নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। তৌহিদী জনতার নাম করে এগুলো করা ইসলাম সম্মত না।”
‘তৌহিদী জনতা’র এই দৌরাত্ম্য নিয়ে ফেইসবুকে অনেক লেখালেখি চলছে। সেখানে অনেক ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) এর মৃত্যুর কথা স্মরণ করে লিখেছেন, ‘তৌহিদী জনতা’র হাত থেকে তিনিও প্রাণে বাঁচতে পারেননি।
সমালোচনার মুখে পড়া হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, “তৌহিদী জনতার ব্যানারে কোনো বিতর্কিত বা আইনবহির্ভূত কাজ করা যাবে না। এটা আমরা সমর্থন করি না।”
তাহলে এই তৌহিদী জনতা কারা- প্রশ্নে তিনি বলেন, “যত মুসলমান আছে, তারা সবাই তৌহিদী জনতা। আর হেফাজতে ইসলাম তো সকল তৌহিদী জনতার সংগঠন।
“কখনো কখনো হয়ত কেউ হেফাজতে ইসলামের ব্যানার ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন অথবা নেতৃবৃন্দের অনুমতি নেওয়া হয়নি, তখন অনেকে তৌহিদী জনতার ব্যানারে কাজ করেন।”
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকবিষয়ক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সক্রিয় ব্যক্তিদের সক্রিয়তা বিশ্লেষণ করে ফেইসবুকে লিখেছেন, “তৌহিদী জনতার স্বতস্ফুর্ত কাণ্ড বলে প্রচার চালানো হলেও দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনাগুলোতে মানুষ জড়ো করার পেছনে উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয় ব্যক্তিদের কো-অর্ডিনেশনের বিষয়টি স্পষ্ট।”
গত নভেম্বরে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে দু’দিনব্যাপী বিক্ষোভ এবং গরু জবাই, ডেইলি স্টার কার্যালয়ের গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ এবং শাহবাগ থানা থেকে নারী হেনস্তাকারীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার বিক্ষোভ- এই তিনটি বিক্ষোভে অন্তত তিনজনকে সব জায়গায় দেখা গেছে।
এদের মধ্যে দুজনের নাম ও পরিচয় জানিয়েছেন শিশির। তারা হলেন- আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান এবং আতাউর রহমান বিক্রমপুরী।
শের মোহাম্মদকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার অর্থ সরবরাহকারী সদস্য হিসেবে আটক করে র্যাব। ৫ আগস্টের পর আল-কায়দার কালো পতাকার সমর্থনে প্রচার চালাতেও দেখা যায় তাকে।
বিক্রমপুরী তার ওয়াজ, অনলাইন বয়ান ও ফেইসবুকে উগ্র কথাবার্তা প্রচারের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি তিনি তার এক ফেইসবুক পোস্টে বায়তুল মোকাররামের বর্তমান খতিব মাওলানা আব্দুল মালেককে মুনাফেক আখ্যায়িত করেন।
তিনি ‘এন্টি শাতিম মুভমেন্ট’ নামে একটি ফেইসবুক পেইজ চালান। সেখানে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে ‘শাতিমে রসুল’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা গেলে তাকে হত্যার আহ্বান জানানো হয়। গণতন্ত্র চর্চাকারী মুসলমানদেরকে ‘কাফির’ তকমা দিয়ে তিনি নিয়মিত পোস্ট করেন। নাস্তিকদের হত্যা করার জন্যও তিনি উস্কানি দেন।
বিক্রমপুরী আইএসকে খারেজি বা পরিত্যাজ্য মনে করলেও আল-কায়দা ও তালেবানকে সঠিক পথের দল মনে করেন। ২০২১ সালে তাকে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিক্রমপুরী কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মুক্তির জন্য কাজ করা বৈষম্যহীন কারামুক্তি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। ৫ আগস্টের পর তিনি তার দলবল নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের মুক্ত করে আনার জন্য জড়ো হয়ে কর্মকর্তাদের জেরা করেছিলেন।
আবার ‘তৌহিদী জনতা’কে নামিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী চরমপন্থিদের কব্জায়, তা বোঝার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, “আমার ধারণা কেউ বা কোনো মহল এই তৌহিদী জনতার ব্যানার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আবার কেউ তাদের ব্যবহার করছে। সরকারের এটা দেখা উচিৎ।”
এদিকে সার্বিকভাবে নারীরাই আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে উল্লেখ করে এসব ঘটনার প্রতিকারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, “নানা অজুহাতে নারীকে হেনস্তা ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। গণপরিসরে নারীর নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।”
এসব ঘটনা নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা, স্বাধীন চলাচল, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে মনে করে মহিলা পরিষদ। সংগঠনটির নেতারা মনে করেন, এসবের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তাই এ পরিস্থিতির অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে মহিলা পরিষদ। এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।