রাখাইন ঘিরে হচ্ছেটা কী?

মিয়ানমারের রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
মিয়ানমারের রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

শুভেচ্ছা সফরে রাশিয়ার তিনটি রণতরী বাংলাদেশের জলসীমায় অবস্থানের মধ্যে ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বলা হচ্ছে, তাদের সফরের উদ্দেশ্য মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। ঢাকায় বৈঠকে তাদের সঙ্গে রাখতে মিয়ানমারে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকেও আনছেন তারা।

এর কয়েকদিন আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেন। জাতিসংঘে এক সময় কাজ করে আসা খলিলুর যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা হিসাবেই পরিচিত।

গত মাসে বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সরবরাহে বাংলাদেশ দিয়ে একটি করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে যান। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনও হ্যাঁ কিংবা না কিছুই জানায়নি।

তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে বেশ তৎপরতা চালাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। এর মধ্যে তা নিয়ে জাতিসংঘের সমর্থনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

শরণার্থী হয়ে বছরের পর বছর থাকা ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা এরই মধ্যে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে।

কারণ রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা এখন আর মিয়ানমার সরকারের কর্তৃত্বে নেই, তা বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।    

এই আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোত সহযোগিতা দিচ্ছে বলে এর মধ্যে দাবি করেছেন ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী।

ভারতের জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক নর্থ ইস্ট নিউজ নামে একটি অনলাইন পোর্টালে মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই দাবি করেন।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি ডিভিশন মিয়ানমারের দুটি বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে সব ধরনের সহায়তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আর এটা ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মাফিক।

মানচিত্রে মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্য।

মিয়ানমারের বিদ্রোহী দলকে সহায়তা দিতে কক্সবাজারের টেকনাফের কাছে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। এর উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদের মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকে বেগবান করতে যুক্তরাষ্ট্রের যে চাওয়া, তা পূরণ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল অ্যান চুলিক এবং পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এন্ড্রু আর হেরাপ ঢাকায় আসার আগেই আরাকান আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে সেনা কর্মকর্তারা রাখাইন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলবেন বলে চন্দন নন্দীর দাবি। তিনি আরও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল দুটির প্রতিনিধির গোপনে একটি বৈঠকের প্রক্রিয়াও চলছে।

চন্দন দাবি করছেন, রাখাইন নিয়ে একটি সামরিক পরিকল্পনা দাঁড় করাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান রাখাইনে সরবরাহ পৌঁছে দিতে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করছেন।

ভারতীয় এই সাংবাদিক বলেন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হলেও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের এই দলটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ উদ্দেশ্য, জান্তার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিদ্রোহী সব দলকে এক করা।

গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে বি ভোয়েলের ঢাকা সফরটি সামগ্রিক এই প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, লিখেছেন চন্দন নন্দী।

সাবেক কূটনীতিকের ছেলে চন্দন নন্দী এর আগেও বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু বিস্ফোরক খবর দিয়েছিলেন। তার কোনোটি ফলেছে, আবার কোনোটি ফলেনি। সেই খবরগুলো নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ভিত্তিহীন নানা সংবাদ প্রচারের প্রতিবাদ সম্প্রতি জানিয়েছিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তবে চন্দন নন্দীর এই প্রতিবেদন নিয়ে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

নানা সূত্রে খবর মিলছে, রাখাইন রাজ্য থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি হটিয়ে দিতে শিগগিরই অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। চীনঘেঁষা জান্তা সরকারের বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের সহায়তা করবে।

আরকান আর্মির যোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য কে বানলালবেনা।

 রাখাইনের তিনটি শহর সিত্তে, কিয়াউকপিউ ও মান আউং এখনও দেশটির সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য এখন সেগুলো কব্জায় আনা।

তবে এক্ষেত্রে ভারতেরও আগ্রহ থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত শুধু রাখাইনের সঙ্গে। এর পাশের চিন নামে রাজ্যের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত। এই রাজ্যটিও এখন বিদ্রোহী দল চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণে।

রাখাইনের সিত্তে বন্দর উন্নয়নে কাজ করছে ভারত। এটি ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের’ অংশ। এই প্রকল্পের লক্ষ্য রাখাইনের বন্দর ব্যবহার করে মিজোরাম পর্যন্ত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

সিত্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, যা চিন রাজ্যের পালেতওয়ার সঙ্গে স্থলপথে সংযুক্ত। পালেতওয়া থেকে ভারতীয় রাজ্য মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত স্থলপথে সংযোগ রয়েছে। পালেতওয়া এখন আরাকাক আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর নয়া দিল্লি কেবল সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করায় ভারতের অবস্থানও বদলেছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য কে বানলালবেনা অপ্রত্যাশিত এক সফরে সীমান্ত পেরিয়ে চিন রাজ্যে ঢুকে আরাকান আর্মির সঙ্গে বৈঠকও করে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দি ডিপ্লোমেট সেই খবর দিয়েছিল, সঙ্গে আরাকার আর্মির যোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের পার্লামেন্ট সদস্যদের ছবিও ছাপিয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতের লক্ষ্য কালাদান প্রকল্প ঠিক রাখা।

মিয়ানমারে চীনেরও রয়েছে বড় স্বার্থ। দুই দেশের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। খনিজ সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষিত রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ। সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। বঙ্গোপসাগরে চীনের বের হওয়ার পথ মিয়ানমারই।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের জান্তাদের মদদ দিয়ে এলেও ২০২১ সালের ক্যু নিয়ে অখুশি ছিল। এখন গৃহযুদ্ধে জান্তার পিছু হটা বেইজিংয়ের বড় উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছে।

কারণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট। ফলে জান্তা সরকারের যদি পতন ঘটে, তাহলে মিয়ানমারে নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখা যে দুষ্কর হবে, তা আঁচ করতে পেরে বিদ্রোহীদের সঙ্গেও এখন সম্পর্ক গড়তে চাইছে চীন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আর এই পরিস্থিতিতে চীনকে চাপে ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। আর নিজেদের স্বার্থে চীন ঠেকানোর এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হতে পারে ভারত। 

সব মিলিয়ে ঘোলাটে এক পরিস্থিতিতে গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সেই কথাটি আবার সামনে আসছে, বঙ্গোসাগরে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

চট্টগ্রামে নোঙর করা তিনটি রুশ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে কেন এত কৌতূহল?

বঙ্গোপসাগরে যখন রুশ রণতরী, তখন ঢাকায় আসছেন মার্কিন ২ কর্মকর্তা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads