বৈষম্যবিরোধীরা কি এখন ভারতের কাছে ভিড়ছে?

ঢাকার ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে সংলাপে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
ঢাকার ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে সংলাপে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।

গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা নয়া দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়াার পর ভারতকে শত্রুদেশ জ্ঞান করছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢলে পরের মাসে বন্যার পর ভারতকে লক্ষ্য করে তাদের বাক্যবান আরও বাড়ে।

ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা হবে- ডিসেম্বরের শুরুতে এমন কথা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর মুখে। অন্য সমন্বয়করাও কড়া বার্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতকে।

এই আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার মাহফুজ আলম ডিসেম্বরের শেষে আরেক কাঠি বেড়ে ভারতের কিছু অংশ নিয়ে বাংলাদেশের একটি নতুন মানচিত্রও প্রকাশ করেন তার ফেইসবুক পাতায়। যদিও পরে তা সরিয়ে নেন, তবে তা নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল কয়েকদিন।

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা যখন কড়া কড়া কথা বলছিলেন, তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দল বিএনপির সুর তাদের মতো চড়া ছিল না। বিএনপি বরাবরই আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট বলে সমালোচনা করত। কিন্তু বৈষম্যবিরোধীরা তার চেয়ে বেড়ে দিল্লির দাস হিসাবে আওয়ামী লীগকে চিহ্নিত করে বিএনপিকে নিয়েও আকারে-ইঙ্গিতে সমালোচনা করেছিল।

কিন্তু হঠাৎ করেই দুই পক্ষের অবস্থানে ছন্দপতন দেখা যাচ্ছে। বিএনপি যখন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চেয়ে উত্তরাঞ্চলে কর্মসূচিতে নেমেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন নয়া দিল্লিকে হুঁশিয়ার করে বলছেন যে ‘ভারত শুধু পলাতক স্বৈরাচারকে মনে রেখেছে’; তখন নতুন দল গঠনের পথে থাকা বৈষম্যবিরোধীদের ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শোনা গেল নরম সুর।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা নাগরিক কমিটির আয়োজনে ঢাকার ইস্কাটনে বিআইআইএসএস মিলনায়তনে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক এক সংলাপে আলোচকরা যেমন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার কথা বলেছেন, তেমনি নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কথায়ও আগের তেজ ছিল না।

মঙ্গলবার বিএনপি ও নাগরিক কমিটির কর্মসূচির আগের দিনই আবার ভারতের সংবাদপত্র দ্য হিন্দুকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন যে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হচ্ছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক। তারপর নানা সময়ে তাতে চড়াই-উৎরাই দেখা গেলেও গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যে অবস্থা দাঁড়ায়, তা আগে কখনও দেখা যায়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার আগে মুহাম্মদ ইউনূস নয়া দিল্লিকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে বাংলাদেশ অস্থির হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও শান্তি থাকবে না।

তবে কিছু দিনের মধ্যে ভারত নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুর নরম হতে থাকে; যদিও অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা হওয়া যুবকরা ছিলেন ব্যতিক্রম। ডিসেম্বরে মাহফুজ যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে বাংলাাদেশের মানচিত্র প্রকাশ করেন, তখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছিল যে এটা সরকারের অবস্থান নয়।

এরপর বৈষম্যবিরোধীদের চাপে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নয়া দিল্লিতে চিঠি অবশ্য পাঠিয়েছিল সরকার। কিন্তু তাতে ভারত সরকারের হেলদোল না দেখে তা নিয়ে খুব বেশি আর তৎপরতা দেখায়নি। শুধু শেখ হাসিনার মুখ বন্ধ রাখতে দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।

ভারতের সঙ্গে টানাপড়েনের সম্পর্কের ছয় মাস গড়ানোর পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত রোববার ওমানের রাজধানী মাস্কাটে অষ্টম ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে দুই দেশের সম্পর্কে যে চ্যালেঞ্জগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানে একসঙ্গে কাজ করতে একমত হন তারা।

তার একদিন বাদে হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তৌহিদ খোলাখুলিভাবেই বললে, গত অগাস্টে তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন দুই পক্ষের সম্পর্ক খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।

এখনকার সঙ্গে তখনকার তুলনা করে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় ছয় মাসের মাথায় সেটা আসলেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের এমন একটি পরিবেশের প্রয়োজন, যেখানে আমরা একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে পারি। ছয় মাস আগের তুলনায় অবশ্যই আমরা একে অপরের সঙ্গে অনেক ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারি।”

ঢাকা-নয়া দিল্লির উত্তেজনার পারদ নামার খবর যখন তিনি দিচ্ছেন, তখন বিএনপি তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে তিস্তা পাড়েরর পাঁচ জেলাজুড়ে ১১টি পয়েন্টে দুদিনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।

মঙ্গলবার এই কর্মসূচির শেষ দিনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি শেখ হাসিনার ভারতঘেঁষা নীতি বোঝাতে ক্ষমতাচ্যুত এই প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাটি বলেন- “ভারতকে যা দিয়েছি… সারাজীবন মনে রাখবে।” তারপর বলেন, “ভারত শুধু পলাতক স্বৈরাচারকে মনে রেখেছে, বাংলাদেশের জনগণকে তারা মনে রাখেনি।”

ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে করা বিভিন্ন চুক্তি পুনঃমূল্যায়নের কথা বলেন তারেক; যাকে বিএনপি নেতা-কর্মী দল ও দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার মনে করে।

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি তিনি বলেন, পানির ন্যায্য হিস্যার আদায় করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামেও যাবে।

অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে বিএনপির মতভেদ ক্রমে বাড়ছে। তার মধ্যে বৈষম্যবিরোধীদের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াও বিএনপি নেতারা সন্দেহের চোখে দেখছে।

বিএনপির এই কর্মসূচি চলার মধ্যেই ঢাকায় ‘গণ–অভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি : নতুন দিগন্তের সন্ধানে’ শিরোনামে দিনব্যাপী সংলাপ আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটি; যাদের উদ্যোগে এই মাসেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা রয়েছে।

এই সংলাপের প্রথম অধিবেশনে বিএনপি বলয়ের হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “ভারত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং চারদিক দিয়ে পরিবেষ্টিত। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলে অশান্তি হয়। ভারত চাইবেই বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় নিতে। কারণ, এর সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। আর শুধু ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব দেশই নিজের স্বার্থ দেখে। বাংলাদেশ শুধু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিল।”

ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার কথা সংলাপে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান এ এস এম আলী আশরাফ।

পরারাষ্ট্র নীতিতে অর্থনৈতিক বিষয়ে জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “দেখতে হবে, কাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশি। রাতারাতি এই বাণিজ্য অংশীদার পরিবর্তন করা যাবে না। এদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে বাজার আরও বিস্তৃত করায় মনোযোগ দিতে হবে।”

এখানে বলে রাখা যায়, কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য কমেনি বাংলাদেশের। সাত মাসে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য নগণ্য পরিমাণ।

সংলাপে এমন সব বক্তব্য আসার পর জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতজানু অবস্থার জন্য মূলত বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদেরই দোষ দেন।

তিনি বলেন, “গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ শুধু দিয়েছে। বাহাত্তরে একটি দেশের কাছে দেশের পররাষ্ট্র নীতি বিক্রি করে দেওয়া হয়। একটি দেশের সেবাদাস হিসেবে থেকেছে। সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো যায়নি।”

এখন ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইটা করার ক্ষেত্রে স্লোগানমুখিতা থেকে সরে আসার পরামর্শ দেন তিনি, যা অগাস্টের পর তারা দিয়ে আসছিলেন।  

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “ভারতের বিরুদ্ধে সারা দিন স্লোগান দিয়েও হবে না, বরং ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলতে হবে। ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিতে হলে বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি থাকতে হবে।”

নতুন যে রাজনৈতিক দল হচ্ছে, তার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নাসীরুদ্দীনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে তাদের কমিটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

সংলাপে নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম আরেকটি অধিবেশনে বক্তব্যে দৃষ্টি ভারতে কেন্দ্রীভূত না করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “আমাদের দৃষ্টিটা অনেক তীক্ষ্ণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম এখন তাদের জায়গা থেকে অন্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেবেন। আমাদের দৃষ্টি আর তিন দেশ—ভারত, চীন ও আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। রাশিয়া-জাপান-মধ্যপ্রাচ্য ও জিব্রাল্টার প্রণালী হয়ে পানামা খালের দুই পাশের দুই আমেরিকা পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টি থাকবে।”

ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি যে বার্তা দেন, তার মধ্যেও আগের সেই কঠোরতা ছিল না।

সারজিস বলেন, “কেউ যদি প্রভাবের মানসিকতা খাটাতে চায়, তাদের প্রতি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আপনাদের অ্যাপ্রোচ আমাদের প্রতি যা হবে, আমাদের মনোভাবও আপনাদের প্রতি একই হবে। আমরা কারও ওপর নির্ভরশীল নই, আমরা মিউচ্যুয়ালি ডিপেনডেন্ট।”

রাজনৈতিক দল গঠনের ঠিক আগে তাদের এই নরম সুর বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে পর্যবেক্ষক মহলে। কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে কি ভারত নতুন গুটি বেছে নিয়েছে? সে কারণেই কি বিএনপিও হঠাৎ তাদের মোড় বদলেছে?

আরও পড়ুন