গত বছরের ৫ আগস্ট দিনের শুরুতে ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। কারফিউ চলছিল, সড়কে টহলে ছিল সেনাসদস্যরা। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড বসিয়ে চালাচ্ছিল তল্লাশি। ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ, সব অফিস-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খোলেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দিয়ে ৫ আগস্ট শাহবাগে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন সকালে সেদিকে কাউকে যেতেই দিচ্ছিল না পুলিশ।
আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা সরকারের কড়া হুঁশিয়ারির পর সেদিন সকালের ঢাকা দেখে ধারণা করা কঠিন ছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চিত্র বদলে যাবে। দুপুরের আগে আকাশে হেলিকপ্টারের ওড়াওড়ির পর খবর ছড়ায় শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। তারপর রাজপথ জনতার দখলে।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় দেওয়া সাক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তখনকার সমন্বয়ক এবং মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম ৫ আগস্ট সকালের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা একই রকম।
কিন্তু সাক্ষ্যে তিনি বলেছেন, তার আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্টই সরকার প্রধান হতে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তারা।
তিনি বলেন, “আমরা ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল করার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করছিলাম। মাহফুজ আলম এই সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। নতুন সরকার গঠনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করি এবং তাকে সরকারপ্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিই।”
তার এই সাক্ষ্যের পর সোশাল মিডিয়ায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি নাহিদরা জানতেন যে ৫ আগস্ট সরকার উৎখাত হয়ে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে এভাবে গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। কিন্তু আন্দোলনের চূড়ান্ত লগ্নেও আন্দোলনরত দলগুলো পরবর্তী সরকার প্রধান নিয়ে ভাবেনি।
সেই কারণে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ পদত্যাগ করতে রাজি হলে তারপরই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ঠিক করতে আলোচিনায় বসেছিল দলগুলো। তা ঠিক করতে দুই দিন লেগেছিল, সেই কারণে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর।
এমনকি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগেই ঘাতকরা পরবর্তী শাসক ঠিক করে রেখেছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাহলে নাহিদদের আগেই ইউনূসকে সরকার প্রধান হিসাবে ঠিক করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সেই দাবিকে ভিত্তি দেয়, যা তারা করে আসছেন শুরু থেকেই।

গত বছর ইউনূস নিউ ইয়র্কে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জুলাই আন্দোলন ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন’ করা, অর্থাৎ সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত। এই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে মাহফুজকে পরিচয়ও করিয়ে দেন তিনি।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল হচ্ছে জুলাই আন্দোলন। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভার্চুয়ালি বিভিন্ন সভায় যুক্ত হয়ে একই কথাই বলে আসছেন।
বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে দশককাল আগের ‘আরব বসস্ত’র মিল তুলনা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো শুরু থেকেই করে আসছে।
রাশিয়া অবশ্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই সতর্ক করে বলেছিল, বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে আরব বসন্তের মতো কিছু করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই হুঁশিয়ারি কেউ কানে দেয়নি।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও জুলাইজুড়ে বলে আসছিল, তাদের আন্দোলন সরকার হটানোর আন্দোলন নয়।
সরকারের দমন-পীড়নে কয়েকশ মৃত্যুর পর ৩ মার্চ আলোচনার সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যা্ন করে সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরদিন ঘোষণা হয়েছিল, ‘মার্চ টু ঢাকা’ হবে ৬ আগস্ট।
কিন্তু তা পরে একদিন এগিয়ে আনার ব্যাখ্যাও বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যে দেন নাহিদ, যিনি এখন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকার কারফিউ ঘোষণা করে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের কাছে তথ্য আসে যে সরকার মার্চ ব্যর্থ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে এবং একইসঙ্গে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া হত্যাকাণ্ড বা গুমের আশঙ্কাও তৈরি হয়। এজন্য তারা ৪ আগস্টই পরে ঢাকা মার্চ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন।
তার এই বক্তব্যেও ৪ আগস্ট সরকারের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট। ফলে তার একদিন বাদেই সরকারের পতন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে ঢাকার বাইরে ৩ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলে যাওয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ৪ আগস্ট সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়াসহ অবসরপ্রাপ্ত একদল সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন। পরদিন ৫ আগস্ট সকালে তারা মানববন্ধনেও দাঁড়িয়েছিলেন।
৫ আগস্ট সকালের পর সেনাবাহিনীর অবস্থান বদলেল বিষয়টি নাহিদের সাক্ষ্যেও আসে। তিনি বলেন, ওইদিন সকালে তারা শাহবাগে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শহীদ মিনার ও চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। এরমধ্যে সেনাবাহিনী এক পর্যায়ে রাস্তা ছেড়ে দিলে তারা শাহবাগে অবস্থান নেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যে শাহবাগ জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিবর্তনের একটি উত্তর পরে পাওয়া যায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ভলকার টুর্কের এক বক্তব্যে। তিনি কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালালে তার পরিণতিতে জাতিসংঘ মিশন বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এমন সতর্কবার্তা তারা দিয়েছিলেন।
ইউনূস কী করেছিলেন?
সরকার থাকতেই আরেকটি সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ইউনূস কেন কিছু তখন জানাননি? সেই প্রশ্নও উঠছে কারও কারও মনে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের আগে সেই পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন বলে পরে জানান খুনিদের অন্যতম সৈয়দ ফারুক রহমান।
১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের আই টিভিতে দেওয়া এক অনুষ্ঠানে ফারুক বলেছিলেন, পরিকল্পনা ঠিক করে তারা প্রথমে মেজর জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ।
ফারুকের ভাষ্য অনুাযায়ী জিয়া তাকে বলেছিলেন, “আমি একজন সিনিয়র অফিসার; আমি এ ধরনের ব্যাপারে জড়িত হতে পারি না। তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি এটা করতে চাও, তাহলে এগিয়ে যাও।”
জিয়া পরে তার এডিসিকে বলেছিলেন, ফারুক ও আব্দুর রশীদকে যেন তার কাছে আসতে আর না দেওয়া হয়। কিন্তু এমন একটি ষড়যন্ত্রের কথা জেনেও তা প্রতিরোধ কিংবা তা সরকারকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।
এমন প্রস্তাব পেয়ে ইউনূস কী করেছিলেন, তার উত্তর পাওয়া যায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে।
জুলাই আন্দোলনের সময় ইউনূস ছিলেন ফ্রান্সে, আর অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্বে তিনি ছিলেন প্যারিসের একটি হাসপাতালে।
গত অক্টোবরে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, “আমি তখন বিদেশে ছিলাম, যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। প্যারিস অলিম্পিকে একটা দায়িত্ব পালন করছিলাম। ওটার ডিজাইনিংয়ে আমি ইনভলভড ছিলাম। এ সময়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় প্যারিসের একটা রাস্তার নাম আমার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, সেটার উদ্বোধন করেছিলাম।”
দিন-তারিখ উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়? তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা।
“তাকে (ইউনূস সেন্টারের কর্মকর্তা) বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখো।”

চাপাচাপিতে পড়ে এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন জানিয়ে ইউনূস বলেন, “তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই, আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল? তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে।
“আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ যে আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি এ ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন যে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।”
“এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতার মতো। আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম,” বলেছিলেন ইউনূস।