ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সব প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব বদলের হাতিয়ার হয়েছিল একটি মাত্র শব্দবন্ধ, তা হলে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’।
অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিরা এই ধুয়া তুলে সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়-সচিবালয় রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের আনার পথ সুগম করে।
তখন বিএনপি ও অভ্যুত্থানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক দিকেই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে ধীরে ধীরে তাদের নিজেদের ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে থাকে।
গত ফেব্রুয়ারিতে যখন অভ্যুত্থানকারী তরুণরা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিয়ে মাঠে নামে, তখন দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে। নির্বাচন কবে, সেই প্রশ্নে এখন সেই দূরত্ব পাল্টাপাল্টি আক্রমণে রূপ নিয়েছে।
বুধবার দুই পক্ষের এক ধরনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দিকেও গেল আক্রমণের তীর। ‘আওয়ামী লীগের দোসর’হীন প্রশাসনে এবার ট্যাগ লাগছে উপদেষ্টাদের গায়ে।
তিনজন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও আসিফ নজরুলকে ‘বিএনপির লোক’ আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে এনসিপির সমাবেশ থেকে।
অন্যদিকে এনসিপির প্রতি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিএনপির কর্মসূচি থেকে।
রাষ্ট্রপতি অপসারণ, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে এনসিপি ও বিএনপির বিরোধ আগে দেখা গিয়েছিল, এবার তা বড় আকারে দেখা যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বিএনপির ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব না দেওয়া নিয়ে।

পাঁচ বছর পর ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ডিএসসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে হেরে বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর এই বছর ট্রাইব্যুনাল রায় দেয় এবং তাতে ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে।
একইভাবে অভ্যুত্থানের পর আদালতের রায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে শপথ নেন বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। কিন্তু ঢাকায় ইশরাকের শপথ আয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গড়িমসি শুরু করে, যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইশরাকের সমর্থক বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক সপ্তাহ আগে ঢাকা দক্ষিণের নগর ভবন অবরোধ করে। তাদের সেই কর্মসূচি টানা চলছে। বিএনপির জাতীয় নির্বচহী কমিটির সদস্য ইশরাকের ডাকে কর্মসূচি শুরু হলেও তার পেছনে যে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থন রয়েছে, তা নেতাদের কথায় স্পষ্ট।
সোমবার সেই কর্মসূচি থেকে আসিফ মাহমুদের ছবিতে জুতাপেটা করা হলে তার ও তার আন্দোলনের সঙ্গীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। বিএনপি ‘গায়ের জোর’ দেখাচ্ছে দাবি করে আসিফ মাহমুদ বলেন, আইনি জটিলতার কারণেই ডিএসসিসির মেয়র পদে ইশরাকের শপথ অনুষ্ঠান করা যাচ্ছে না। আদালতেই এর সুরাহা হবে।
এরপর নিজেদের গায়ের জোর দেখাতে এনসিপি বুধবার নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করে। সেখান থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। ওই কর্মসূচির নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা আসিফ মাহমুদেরই আন্দোলনের সহযোগী। আর নির্বাচন নিয়ে তাদের দাবি বিএনপির ঠিক উল্টো।
সেই ঘেরাও কর্মসূচিতে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বোধীন অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ বলেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া তাদের সুপারিশ মানা না হলে এই তিন উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করানোর হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
নাসীরুদ্দীন বলেন, “বাংলাদেশের এডুকেশন সেক্টর ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য ওয়াহিদউদ্দিন ভাই কাজ করছেন, বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরকে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য সালেহ উদ্দিন ভাই কাজ করছেন, বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয় ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য আসিফ নজরুল কাজ করছেন। আসিফ নজরুলসহ অন্যরা ইসি পুনর্গঠনের যে কলাকৌশল করেছে, তা সরাসরি গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।”
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করে তিনি আরও বলেন, ইসি পুনর্গঠন না হলে বর্তমান ইসির অধীনে এনসিপি নির্বাচনে যাবে না।
অভ্যুত্থানের পর এই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নাম নির্বাচনে গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি একসঙ্গেই কাজ করেছিল।

এদিকে আগারগাঁওয়ে এনসিপি যখন ইসি ঘেরাও করে, তখন গুলিস্তানে নগর ভবন অবরোধ আরো জোরদার করে বিএনপি।
সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে ইশরাক সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে।
তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে, দ্বিতীয় আরেকজন জনাব মাহফুজ আলম, তথ্য উপদেষ্টা, তাকেও পদত্যাগ করতে হবে।”
এনসিপি যেভাবে স্থানীয় নির্বাচনের ধুয়া তুলে জাতীয় নির্বাচন পেছাতে চাইছে, তাদের সেই উদ্দেশ্য পূরণেই উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজ কাজ করছেন বলে ইশরাকের অভিযোগ।
তিনি বলেন, “আদালতের রায় অনুযায়ী আমাকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করানোর কথা ছিল। দুজন উপদেষ্টা এই সরকারে থেকে অনেক কিছুতে হস্তক্ষেপ করছে। উনারা পদত্যাগ করে তাদের রাজনৈতিক দলে সদস্য হয়েছেন বা হতে চান, সেখানে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করুন।”
এই বিষয়ের মীমাংসা না হওয়া অবধি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ইশরাক।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ নেতা-কর্মীদের বলেছিলেন, ইশরাককে মেয়রের পদে বসাতে তাদের রাজপথে নামতে হতে পারে।
এখন এনসিপিও রাজপথে নেমেছে। ফলে কথার লড়াই এখন রাজপথেও হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সে কারণে অভ্যুত্থানের পক্ষের কেউ কেউ বিএনপি ও এনসিপি উভয় পক্ষকে সংযত থাকতে বলছেন।