এনসিপির শাপলায় কী ঘাপলা?

নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে শাপলা চেয়েছে ‘কিংস পার্টি’র তকমা লেগে যাওয়া এনসিপি।
নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে শাপলা চেয়েছে ‘কিংস পার্টি’র তকমা লেগে যাওয়া এনসিপি।

অভ্যুত্থানকারীরা দল গড়েছে সাড়ে চার মাস হয়ে গেল, ভোটে অংশ নিতে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তারা নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে চেয়েছে শাপলা ফুল।

নির্বাচন কমিশন এখনও অনুমোদন না দিলেও শাপলাকে নিজেদের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে প্রচার চালাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শুধু তাই নয়, দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এটাও বলে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০ আসনে শাপলা প্রতীকে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।

জাতীয় সংসদে এখন আসন সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে ৩৫০টি। তা বাড়াতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তার আগেই ৪০০ আসনের কথা বলে দিচ্ছেন পাটওয়ারী।

আবার নির্বাচন কমিশনে সংসদ নির্বাচনের প্রতীকের তালিকায় শাপলা নেই। তারপরও শাপলা পেয়ে যাচ্ছেন, এমনটাই ধরে নিচ্ছেন এনসিপির নেতারা।

কিন্তু যেখানে শাপলা জাতীয় ফুল এবং সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় প্রতীক, সেখানে তা নির্দিষ্ট কোনও দলকে প্রতীক হিসাবে দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও রয়েছে আইনি প্রশ্ন।

এখন এনসিপির শাপলা চাওয়া এবং তা পেতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনায় সরগরম সোশাল মিডিয়াসহ রাজনৈতিক অঙ্গন।

এনসিপি শাপলা কেন চায়?

শেখ হাসিনাকে হটানোর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা এনসিপি গড়ার সাড়ে চার মাস পর গত ২২ জুন নিবন্ধন আবেদনসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ইসিতে জমা দেয়।

সেই আবেদনে তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে প্রথম পছন্দ হিসেবে ‘শাপলা’র কথা জানায়। বিকল্প হিসেবে কলম ও মোবাইল ফোনের কথা লিখলেও শাপলাই পাবে বলে ধরে নিয়েছেন এনসিপি নেতারা।

নিবন্ধনের আবেদনের পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ এনসিপির শীর্ষ নেতারা। সেখানেও তারা শাপলা প্রতীক তাদের দেওয়ার কথা বলেন।

নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এনসিপির নেতারা।

নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের প্রথম পছন্দ শাপলা। আশা করছি, জনগণের মার্কা হিসেবে, গণঅভ্যুত্থানের মার্কা হিসেবে, গ্রাম বাংলার প্রতীক হিসেবে এনসিপি শাপলা পাবে।”

শাপলাকে প্রতীক হিসেবে নেওয়ার কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, “শাপলা আসলে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলাকে প্রেজেন্ট করে। বাংলাদেশের নদী, প্রকৃতি ও জলাশয়ের সাথেই জড়িয়ে শাপলা। যে কারণে আমরা মনে করছি রাজনীতিতেও এর প্রতিফলন থাকুক।”

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রতীক হওয়া উচিৎ জনমানুষের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতীক হচ্ছে সেটা, যেটার সাথে মানুষ নিজেদের কানেক্ট করতে পারে।

“শাপলাটা হচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটা প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের প্রতিটা প্রান্তে শাপলার একটা উপস্থিতি আছে। যেটার সাথে মানুষ কানেক্ট করতে পারে। যে কারণে শাপলা প্রতীক হিসেবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

শাপলা ফুল সবার কাছে পরিচিত বলে ভোটে তা সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন এনসিপির নেতারা। আবার ২০১৩ সালে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সভাটি হয়েছিল মতিঝিলেরর শাপলা চত্বরে, সেই সমাবেশ পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ সরকার গণহত্যা চালিয়েছিল বলে ধর্মীয় সংগঠনটি দাবি করে।

এনসিপির সঙ্গে হেফাজতের বেশ ঘনিষ্ঠতা দৃশ্যমাণ। হেফাজত যেহেতু নির্বাচন করে না, সেহেতু তাদের ভোট টানার ক্ষেত্রে শাপলা সুবিধা দিতে পারে, তাও এনসিপি নেতাদের কথায় উঠে আসছে।

ইসির তালিকায় শাপলা নেই

এক সময় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পছন্দ মতো প্রতীক নিয়ে ভোট করত। এক প্রতীকের একাধিক দাবিদার হলে তখনই কেবল মীমাংসা করত ইসি। কিন্তু ২০০৮ সালে নিবন্ধন চালুর পর এগুলো নিয়মের মধ্যে আসে।

বিভিন্ন নির্বাচনের জন্য এখন আলাদা আলাদা প্রতীক সংরক্ষণ করছে ইসি। সংসদ নির্বাচনের জন্য এখন বরাদ্দ ৬৪টি প্রতীক।

বিধিমালায় বলা আছে, কোনো প্রতীদ্বন্দী প্রার্থীকে, এই বিধির বিধানাবলী সাপেক্ষে সংক্ষিত প্রতীকগুলো থেকে যে কোনো একটি বরাদ্দ করা যাবে।

এগুলো হল-  আম, কাঁঠাল, আপেল, ডাব, তরমুজ, কলার ছড়ি, ফুলকপি, ফুলের মালা, গোলাপফুল, বটগাছ, খেজুর গাছ, উদীয়মান সূর্য, একতারা, কবুতর, কুমির, বাঘ, সিংহ, গরুর গাড়ি, গাভী, গামছা, কুলা, কাস্তে, মাথাল, কুড়াল, কোদাল, চাকা, কুঁড়েঘর, খাট, ঘণ্টা, চাবি, চেয়ার, ছড়ি, ছাতা, ট্রাক, টেলিভিশন, তবলা, হাতুড়ি, তারা, দাবাবোর্ড, দালান, দেওয়াল ঘড়ি, ধানের শীষ, নোঙ্গর, নৌকা, বাই-সাইকেল, বাঁশি, বেঞ্চ, বেলুন, মই, মটরগাড়ি, মশাল, মাছ, মিনার, মোমবাতি, রকেট, রিক্সা, লাঙল, শঙ্খ, স্যুটকেস, হাত (পাঞ্জা), হাত ঘড়ি, হাত পাখা, হারিকেন, হুক্কা।

এসব প্রতীকের মধ্যে শাপলা নেই। স্বাভাবিকভাবে কোনো দলকে এই প্রতীকের মধ্য থেকে একটি বেছে নিতে হয়।

শাপলায় ঘাপলা

শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। পাশাপাশি এটি জাতীয় প্রতীকেও রয়েছে। ফলে কোনো দল এটি এককভাবে ব্যবহারের অধিকারী নয় বলে আইনজ্ঞদের মত।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগেই আছে- প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ চরণ, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা সবুজ ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত, প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পরসংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুটি করে তারকা৷

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার ১৯৭২ এ বলা আছে, আমাদের জাতীয় প্রতীক হবে শাপলা। এতে ধানের শীষ ও পাটের কুড়ি থাকলে, শাপলাটাই হচ্ছে মূল। যে কারণে শাপলা কোনো একটি দলের প্রতীক হতে পারে না।”

একারণে কোনো একটি দলকে শাপলা প্রতীক দেওয়া উচিৎ হবে না বলে মত দেন শাহদীন মালিক, যাকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করেছিল মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, কিন্তু তিনি সেই দায়িত্ব নেননি।

তবে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শাপলা এককভাবে জাতীয় প্রতীক নয়, তার সঙ্গে আরও বিষয় যুক্ত। ফলে শুধু শাপলা ফুল দলীয় প্রতীক করতে বাধা নেই। আর জাতীয় ফল কাঁঠাল যেহেতু নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে রয়েছে, সেক্ষেত্রে জাতীয় ফুলের ক্ষেত্রে বাধা কেন আাসবে?

এই যুক্তি খণ্ডন করে সাবেক সচিব ও নির্বাচন বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জাতীয় প্রতীকে আরও অনেক কিছু থাকলেও শাপলাটাই মূল। কেননা জাতীয় প্রতীকে শাপলাকে যতটা বড় করে দেখা যায়, অন্য বিষয়গুলো অতটা ভালোভাবে বোঝা যায় না।”

ইসি কী করবে?

প্রতীকের তালিকায় শাপলা না থাকলেও এনসিপিকে শাপলা দিতে ইসির মধ্যে নরম সুরই দেখা যাচ্ছে; যদিও অন্য একটি দল শাপলা চাইলে তাদের মানা করেছিল ইসি।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন করে যে প্রতীকের তালিকা তৈরি হচ্ছে, সেখানে যদি শাপলা আসে, তখন এটা কেউ না কেউ পাবেই। আমরা শাপলাকে আদৌ যুক্ত করব কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নিইনি।”

নিবন্ধনের জন্য নিজেদের আবেদনপত্র ইসিতে জমা দিচ্ছেন এনসিপির নেতারা। ছবি: সমকাল।

এক সময়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক পালাবদলের পর ইসির নিবন্ধন পেয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট এক সময় আদালতের প্রতীক হিসেবে দাঁড়ি পাল্লা ভোটের প্রতীক হিসেবে না রাখতে বলেছিল ইসিকে। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় ইসি দাঁড়ি পাল্লা প্রতীকও জামায়াতকে দিয়েছে।

ফলে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার সময় যাদের নিজেদের ‘নিয়োগকর্তা’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন ইউনূস, শাপলা প্রতীক পেতে তাদের ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার কোনো সুযোগ দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস কথার পর আগামী বছরের প্রথম অর্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দল ৫০টি। নতুন শতাধিক দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে।

চূড়ান্ত যাচাই বাছাই শেষে এর মধ্যে যে সব দল ইসির নিবন্ধন পাবে, তাদেরকে প্রতীক বরাদ্দ দিতে হবে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যও রাখতে হবে নতুন প্রতীক। কিন্তু ইসির তালিকায় আছে এখন ৬৯টি প্রতীক। ফলে সংখ্যা বাড়িয়ে ১১৫টি প্রতীকের খসড়া তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়। সেখানে শাপলা যুক্ত করা হয়েছে।

অথচ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছর নিবন্ধন পাওয়া মাহমুদুর রহমান মান্নার দল নাগরিক ঐক্য প্রতীক হিসেবে শাপলা কিংবা দোয়েল পাখি চেয়ে সম্প্রতি আবেদন করেও পায়নি।

তখন নির্বাচন কমিশন সচিবের একান্ত সচিব মোখলেছুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “এ দুটি তো জাতীয় প্রতীক। সচিব মহোদয় তাদের অন্য প্রতীক চেয়ে নতুন করে আবেদনের পরামর্শ দিয়েছেন।”

এখন এনসিপিকে সেই প্রতীক দিলে আপত্তি তুলবেন বলে জানান মান্না। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যেটা বলা হয়েছে, যেহেতু এটা জাতীয় ফুল, জাতীয় প্রতীক, এটা দেওয়া যাবে না। তো সেই হিসেবে তাদেরকেও দিতে পারবে না। যদি দেয়, তাহলে প্রশ্ন তুলব।”

শাপলা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শাপলা যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন আমরা দেখব এটার দাবিদার কে কে? তখন অনেক দাবিদার হলে কার দাবিটা বেশি অগ্রগণ্য, সেটা দেখব। এ নিয়ে আগে থেকেই কিছু বলা যাচ্ছে না।”

আরও পড়ুন