‘নিয়মের’ হাতকড়ায় বন্দি মানবতা

সোশাল মিডিয়ায় আসা বাঁয়ের ছবিতে নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে অসুস্থ অবস্থায় হ্যান্ডকাফ পরানো দেখা যাচ্ছে। ডানের ছবিটি তার মৃত্যুর পরের, সেখানেও হাতে হ্যান্ডকাফ।
সোশাল মিডিয়ায় আসা বাঁয়ের ছবিতে নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে অসুস্থ অবস্থায় হ্যান্ডকাফ পরানো দেখা যাচ্ছে। ডানের ছবিটি তার মৃত্যুর পরের, সেখানেও হাতে হ্যান্ডকাফ।

নিথর শুয়ে আছেন নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন; তার হাতে হাতকড়া পরানো। এই ছবি দেখার পর সোশাল মিডিয়ায় চলছে সমালোচনা।

আওয়ামী লীগ আমলের এই মন্ত্রী হত্যা মামলার আসামি হিসেবে বন্দি থাকলেও অসুস্থ অবস্থায়, এমনকি মৃত অবস্থায় তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখতে হবে! এটা বিস্ময়ের ঠেকছে সমালোচকদের কাছে। সেই সঙ্গে তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিও সামনে আসছে। 

আওয়ামী লীগ আমলে এমন কিছু ঘটনার নজির তুলে ধরে কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে বলতে চাইলেও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, তাহলে দুই আমলের পার্থক্য থাকল কি?

নূরুল মজিদ হুমায়ুন নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন মোট পাঁচবার। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি হলেও এবার মন্ত্রিত্ব পাননি। তার সাত মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দলটির আরও অনেক নেতার মতো হুমায়ুনও গ্রেপ্তার হন।

৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক নানা রোগে ভুগছিলেন। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে শনিবার সন্ধ্যায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, দুদিন বাদে সোমবার তার মৃত্যু হয়।

তার হাসপাতালে থাকা অবস্থার এবং মৃত্যুর পরের দুটি ছবি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের ফেইসবুকে তুলে এক পোস্টে লেখেন, “অতীতেও আমরা এ ধরনের প্রচলন দেখেছি যেখানে চিকিৎসারত, এমনকি মৃত ব্যক্তির হাতেও হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে, এখনও দেখছি মরহুম নূরুল মজিদের হাতে হাতকড়া।”

ছবিটি কবেকার- এই বিষয়টি নিশ্চিত হতে প্রথম আলো যোগাযোগ করেছিল কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদের সঙ্গে। তবে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি।

তার বক্তব্য এমন- গত সেপ্টেম্বরে ছয় দফায় নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ছবিটি এই দিনগুলোর মধ্যে কোনো একটি সময়ের হতে পারে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর হুমায়ুনকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকে পাঠানো হয়েছিল ঢাকা মেডিকেলে। ওই কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুরাইয়া আক্তার প্রথম আলোর জিজ্ঞাসায় বলেন, হাতকড়া পরা যে ছবি সোশাল মিডিয়ায় এসেছে, তা হুমায়ুনের মৃত্যুর আগের।

হাতকড়া পরানোর বিষয়ে নিজেদের নিয়মের জালে বন্দি থাকার কথা বলেন সহকারী কারা মহাপরিদর্শক জান্নাত।

তার ভাষ্যে, নিয়ম অনুযায়ী নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দিকে চিকিৎসার সময় হাতকড়া পরিয়ে তা বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয়। অথবা হাতকড়া কোনো কারারক্ষীকে ধরে রাখতে হয়। হাতকড়া খুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

নূরুল মজিদ হুমায়ুন ঢাকায় চারটি মামলা এবং নরসিংদীতে একটি মামলার আসামি। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যার ঘটনায় মামলাগুলো হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কারাগারে তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল মজিদ হুমায়ুনকে হাসপাতালে হাতকড়া পরিয়ে রাখা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, “আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আসামির সঙ্গে নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণ করা যায় না। সেখানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল মজিদ হুমায়ূনের সঙ্গে যেটা ঘটেছে, তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটি মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। একজন আসামি, যিনি মৃত্যুশয্যায়, তার হাতেও হাতকড়া পরিয়ে রাখতে হবে?”

শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে মানুষ আশা করলেও সেই প্রত্যাশা এখন চরম হতাশায় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে নুরুল মজিদ হুমায়ুনকে নিয়ে প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাতকড়া পরিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনার কথা লিখেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমের ডান্ডাবেড়ি পরে তার মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণের খবরও দিয়েছে।

এই সংবাদের সঙ্গে সেই সময় প্রথম আলোর মুদ্রিত সংস্করণের একটি ছবিও দেওয়া হয়েছে। যেখানে হাতকড়া পরে আলী আজমের মায়ের জানাজা পড়ার ছবিটি প্রথম পাতার একেবারে ওপরে তিন কলামজুড়ে ছাপা হয়েছিল।

তবে নুরুল মজিদ হুমায়ুনের হাতকড়ার খবরটি অনলাইন সংস্করণে এলেও মঙ্গলবারের মুদ্রিত সংস্করণে ছিল না। বুধবারের মুদ্রিত সংস্করণে অবশ্য তা আসার সুযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন