“হায় ইতিহাস… এ যেন এক দুঃস্বপ্ন, যা পিছু ছাড়ছে না। আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি।” জেমস জয়েসের ‘স্টিফেন ডেডালাস’ চরিত্রটি সহজেই দক্ষিণ এশীয় জাতির মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই অঞ্চলের দুঃস্বপ্নময় ইতিহাস আরও একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রাস করতে চলেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব জেনে গেছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনার বিচার হয়েছে তারই অনুপস্থিতিতে; দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে।
সময়ের এক অনিবার্য বাঁকবদলে হাসিনা আজ তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুখোমুখি হওয়া পরিস্থিতিরই সম্মুখীন, ১৯৭৫ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যাকে হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। যদিও ভারত সরকার আপাতত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তিনি তার দেশে ফিরে যেতে উন্মুখ, তবুও এই রায় যে সেই দরজা বন্ধ করে দিল তা অনুমেয়।
ক্ষমতা ও শাস্তির চক্র
শেখ হাসিনার এই দণ্ড বাংলাদেশের বর্তমান উত্তাল রাজনৈতিক গতিপথের এমন একটি মোড়ক নির্দেশ করে, যা ক্ষমতা ও শাস্তির করুণ চক্রের এক অস্থির পুনরাবৃত্তি। একসময় তার নেতৃত্ব গ্রহণকে তার পিতার অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক প্রকল্পের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। যে রাষ্ট্রে এখন তাকে নিন্দা জানানো হচ্ছে, তার দেওয়া চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এতটুকু পরিষ্কার, হাসিনার উত্তরাধিকার তার ধারণ করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত মেরুর ওপরই পুনর্নির্মিত। ঠিক যেন তার বাবাকে হত্যার পরের দৃশ্যায়ন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোই নতুন শাসন ব্যবস্থার আত্ম-সংজ্ঞায়নের ভিত্তি হয়ে ওঠেছে। তার ক্ষমতার শেষ বছরগুলোতে দুর্নীতি, ব্যাপক দমন-পীড়ন, গুম এবং ভিন্নমত দমনের নানা অভিযোগে “বিপ্লব”-এর জন্ম। এই উপাখ্যানে, তার বিরুদ্ধে হওয়া গণঅভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়ার যেমন একটি প্রচেষ্টা, তেমনি অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে রূপদানকারীদের বংশভিত্তিক রাজনীতি থেকে প্রতীকী বিচ্ছেদ ঘটানোর একটি উপায়ও বলা যায়।
বিচার প্রক্রিয়া ঘিরে নানা প্রশ্ন এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতে রায় ঘোষণার ফলে বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সন্দেহ থেকেই যায়। তবুও, যেহেতু নতুন শাসকরা সবকিছু মিটমাট করে পুরোনো বিষয় ভুলে যেতে চাইছে, তাই আদালতের এই বিচার প্রক্রিয়াটি কেবল আইনগত বিচার না হয়ে ইতিহাসের বিচার করারও একটি বড় মঞ্চে পরিণত হয়েছে। হাসিনার সমর্থকদের জন্য, এই দণ্ড ন্যায়বিচারের নামে প্রতিশোধমূলক তৎপরতা। আর যারা শেখ হাসিনার সমালোচক, তারা মনে করছে, এই রায় বহু বছর ধরে গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার (কর্তৃত্ববাদী গেঁড়ে বসা) দেরিতে পাওয়া শাস্তি।
এই যে নৈতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি (একদল এটিকে ন্যায় মনে করছে, আরেক দল প্রতিশোধ), এটি দেশের ভেতরের সেই বড় বিভেদগুলোকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে যা স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে; একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে বংশভিত্তিক রাজনীতি বনাম সাধারণ মানুষের আন্দোলন এবং স্বাধীনতার স্মৃতি বনাম এর ফল নিয়ে হতাশা। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস এই দুই মেরুর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে কলঙ্কিত; আর যখন এইসব ঘটনায় নাটকীয়তা যোগ হয়, তখন বিভেদের মাত্রা আরও চওড়া হতে থাকে। তখন বাস্তবতা মেনে নেওয়ার চেয়ে সেইসব প্রতীক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা খুব সাবধানে বেছে নিয়ে কপটতার সাথে ব্যবহার করা হয়। আর সত্যি বলতে, তাৎক্ষণিক লাভ বা সুবিধা ছাড়া অন্য কোনো বাস্তবতার তখন অস্তিত্ব থাকে না!
ভারতের ‘ইঙ্গিত’
অতএব, নির্বাসন কেবল হাসিনার দুর্দশার প্রতীকী গুরুত্বকে বাড়িয়েই দেয়নি, উপরন্তু ভারত সরকারের তাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে জটিল করে তুলেছে। এটি কেবল মানবিক সুরক্ষার একটি কাজ নয়। ভারতে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলে আসা পুরোনো ঐতিহাসিক সম্পর্কের গুরুত্বকে আবারও প্রমাণ করল। এই ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক সম্পর্ককে সমালোচকরা বলেন ভারতের আধিপত্য (জোর খাটানো), আর সমর্থকরা বলেন দুই দেশের মধ্যে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। ভারতের কাছে, হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াটা তাদের একই ইতিহাস ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে বাংলাদেশের নতুন সরকার এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ বা উস্কানি হিসেবে দেখছে, কারণ এটি তাদের পুরোনো সব সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন করে শুরুর দাবিকে দুর্বল করে দেয়। এখন ভারত ও বাংলাদেশ আর জন্মলগ্নের ‘বন্ধু নয়’। এর ফলে দুই দেশের সীমান্তে আবার রাজনৈতিক উত্তেজনার ভয় দেখা দিয়েছে, যা আগের দশকগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন নির্বাসিত নেতারা দেশের সীমানা পেরিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ত্রাতা নাকি অত্যাচারী?
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো শেখ হাসিনার ‘নিজের জীবন’। তিনি এখন দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের চক্রাকার গতির প্রতীক, যেখানে একজন নেতা তার এক জীবনে কখনও ‘দেশকে বাঁচানোর ত্রাতা’ হিসেবে সম্মানিত হন, আবার কখনও ‘অত্যাচারী’ হিসেবে নিন্দিত হচ্ছেন। পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল পারভেজ মুশাররফ এবং নওয়াজ শরিফের ঘটনাগুলোর সাথে এর মিল দেখলে মনে হবে যেন এটি ইচ্ছাকৃতভাবে সাজানো। এরা সবাই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার (আঘাতের) মধ্যে দিয়ে নেতা হয়েছিলেন, এবং ক্ষমতায় আসা ও থাকার জন্য নিজেরা যে সহিংস রাজনৈতিক পথ তৈরি করেছিলেন, ঠিক সেই একই শক্তির কাছেই তারা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। তাই শেখ হাসিনার এই পতন কেবল একজন রাজনীতিবিদের ব্যর্থতা নয়; এটি হলো জাতীয়ভাবে স্মৃতি, বৈধতা ও অসমাপ্ত ইতিহাসের বোঝা নিয়ে লড়াই করার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ পুরনো বিরোধ মিটিয়ে না ফেলে বরং সেগুলোকে বারবার ফিরিয়ে এনে অতীতকে মোকাবিলা করছে, যেন নতুন কিছু করার নামে পুরনো সংঘাতগুলোর পুনরাভিনয় চলছে। যে জাতি তার অতীতকে মেনে নিয়ে সামনে এগোয় না, তারা বারবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়, যেন এই দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা অসম্ভব। জয়েসের সেই দুঃস্বপ্নটিই এখন জাতির নিজস্ব দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে: যা কখনও থামে না, শুধু ঘুরতে থাকে এবং জাগরণকে প্রতিরোধ করে।
নিষ্ঠা গৌতম: দিল্লিভিত্তিক লেখক এবং শিক্ষাবিদ
(মূল লেখাটি এনডিটিভির মতামত বিভাগে ইংরেজিতে প্রকাশিত)



