জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক কিছুই ভুলতে বসা বাংলাদেশিদের ভুলে যাওয়ার ভাণ্ডারে একাত্তরকেও যোগ করতে বলে গেলেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় থেকে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হওয়ার মধ্যে দুদিনের সফরে শনিবারই ঢাকায় আসেন তিনি।
রোববার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বাংলাদেশের উদ্দেশে বলেন, হৃদয় ‘পরিষ্কার’ করতে।
একাত্তরের গণহত্যার স্মৃতি বুকে নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের অনেকেই তার এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হয়ে গেছে বলেও দাবি করেন ইসহাক দার; যদিও তার সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সমাধানের অনেক পথ এখনও বাকি।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানের ভাগে পড়া বাঙালি শুরু থেকেই ছিল শোষণ-বঞ্চনার শিকার। অধিকারের দাবিতে বারবার ঝরাতে হয়েছে রক্ত।
শেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যায় নামলে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামে বাঙালিরা। নয় মাসের লড়াইয়ে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশকে শুরুতে স্বীকৃতি দিতে চায়নি পাকিস্তান। তিন বছর বাদে স্বীকৃতি দিলেও অনেক বিষয় থেকে যায় অমীমাংসিত। সেই কারণে দুই দেশের সম্পর্কও এগোয়নি বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত ১৫ বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেখা যায় উল্টোরথ।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক তরতরিয়ে এগোতে থাকে। ইউনূস নিজে দুইবার বৈঠক করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে; পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করা হয়, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচলও শুরু হয়।
গত এপ্রিল মাসে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসার কথা ছিল। কিন্তু কাশ্মির সীমান্তে যুদ্ধের কারণে তা পিছিয়ে যায়।
পরিবর্তিত সফরসূচিতে শনিবার তিনি ঢাকায় পা রেখেই বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগহরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে।
জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকায় পাকিস্তান হাই কমিশনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হাই কমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফের দপ্তরে অভ্যুত্থানের নেতাদেরও দেখা গেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগকে হটানোর পাশাপাশি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও নির্বাসনে পাঠানোর সব প্রক্রিয়া চলছে। তার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, তার ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে সব দপ্তর থেকে, তার নাম মুছে ফেলা হচ্ছে পাঠ্যবেই থেকে, তার ছবি মুছে দেওয়া হচ্ছে মুদ্রা থেকেও।

গত এক বছরের বাংলাদেশে এসব দেখে আসার মধ্যে ইসহাকত দার রোববার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে “মন পরিষ্কারের” কথা বলেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর কী হবে- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আপনার প্রশ্ন? দেখুন প্রিয় ভাই, ১৯৭৪ সালে ইস্যুটি লিখিতভাবে সমাধান হয়েছে। এই ডকুমেন্টটি ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের কাছেই আছে।
“আর তারপর, যখন জেনারেল মুশাররফ এখানে এসেছিলেন, খুব খোলামেলা এবং অকপটে তিনি এই ইস্যুটি তুলে ধরেছিলেন।”
“এবং আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কিছুর একবার সমাধান হলে, সেটা হয়ে গেছে,” এবিষয়ে অনেকটা সিদ্ধান্ত টেনে দেন তিনি।
তার সঙ্গে যোগ করেন, “পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার কর। সুতরাং চলুন, সামনে এগিয়ে যাই।”
তার এই কথার প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুর নুর তুষার বলেছেন, “বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় পরিষ্কার করার কথা বলার আগে, তাদের উচিৎ হবে নিজেদের হৃদয় পরিষ্কার করে আল্লাহর কাছে তওবা করে মাফ চাওয়া।”
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক-গবেষক সালেক খোকন ফেইসবুকে লিখেছেন, “একাত্তরে মানুষ মেরে পরিষ্কার করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান, এরপর থেকে তাদের দেখলে আমাদের মনও আর পরিষ্কার থাকে না।”
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান শরিফ ফেইসবুকে লিখেছেন, “পৃথিবীতে যে দেশটির মানুষ ৩০ দিন রোজা রেখে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে রক্তাক্ত শরীর- স্বজনের লাশ নিয়ে ঘরে ফিরে আসে সেই দেশটির নাম পাকিস্তান। যাদের নাগরিকদের ভিসা দেবার আগে শর্ত দেয়া হয়- সে যেন লুকিয়ে ভিক্ষা না করে, যে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জেলে বসে অভিযোগ করে সেনা সদস্যরা তাকে বলৎকার করেছে, যারা দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় বিমান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এটাই সেই দেশ। সেই দেশের মন্ত্রী এসে অপর দেশের হৃদয় পরিষ্কার করতে বলে….”
পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে একসাথে চলার কথা কেউ কেউ বলেছেন, তবে তাদের কথায় একাত্তরের গণহত্যা পুরোপুরি উপেক্ষিত থাকছে।
এবিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একাত্তর সালে এখানে গণহত্যার দায়, পাকিস্তানিদের এই দায়টা স্বীকার করতে হবে এবং সেটার জন্য আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তারা বলেছে। কিন্তু আমরা চাই যে, তারা এই দায়িত্বটা নিয়ে প্রকাশ্যে এর একটা সমাধান করুক।”
একাত্তরে গণহত্যার জন্য কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ একাত্তরে ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তবে সেই পারভেজ মুশাররফ দেশটিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। নির্বাসিত জীবনে দুই বছর আগে মারা যান তিনি।
পাকিস্তান থেকে পাওনার কোনো সুরাহাও এখনও হয়নি। পাকিস্তানের কাছে ৪ বিলিয়ন ডলার পাওনার কথা গত এপ্রিলের বৈঠকেও তুলেছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই তা বুঝিয়ে দেননি। এমনকি ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বঙ্গবন্ধু।
বিশেষত দায় ও সম্পদের বন্টন প্রশ্নে পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন।
রোববার বৈঠকের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান কি হয়ে গেছে?
জবাবে তিনি বলেন, “আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটার সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে। আমরা আমাদের অবস্থান বলেছি, ওনারা ওনাদের অবস্থান বলেছেন।”
বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে তৌহিদ বলেন, “আমরা চাই হিসাবপত্র হোক, যেটা টাকা-পয়সার ব্যাপার, সমাধান হোক। আমরা চাই, এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক। আমরা চাই, আটকেপড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নেবে।”
তবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন তৌহিদ হোসেনও। তার দাবি, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পর্ক নষ্ট করা হয়েছিল।