বিদেশি কোম্পানির অনাগ্রহে প্রশ্নের মুখে পিডিবির সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প

সৌর বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, যা বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর।
সৌর বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, যা বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর।

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নেওয়া নতুন উদ্যোগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক চুক্তি বাতিল, নীতির অস্থিরতা এবং টেকসই আর্থিক মডেলের অভাব এই অবস্থার পেছনে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে পিডিবি চারটি আন্তর্জাতিক দরপত্র প্যাকেজ আহ্বান করে, যার আওতায় দেশের ৫৫টি স্থানে মোট ৫,২৩৮ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি গ্রিড-সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম প্যাকেজের দরপত্র খোলা হয় ২ জুন। ছয়বার সময় বাড়ানোর পরেও ওই দরপত্রে কোনো বিদেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। জমা পড়েছে মাত্র ২০টি দরপত্র, যার সবকটি স্থানীয় কোম্পানির পক্ষ থেকে।

বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সক্রিয় চীনা কোম্পানিগুলোও দরপত্রে অংশ নেয়নি। অথচ এর আগে বাতিল হওয়া চুক্তিতে অন্তত চারটি চীনা কোম্পানি ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ পেয়েছিল।

এই ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ১৮৮ মেগাওয়াট মোট সক্ষমতার ৬টি প্রকল্পের জন্য কেবল একটি করে দরদাতা ছিল। এর মধ্যে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামের একটি দেশীয় কোম্পানি ৩০ মেগাওয়াট এবং ৪৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি প্রকল্পে একক দরদাতা হিসেবে আবেদন করে।

অন্যান্য দরদাতাদের মধ্যে টেক্সটাইল ও সিরামিক শিল্প সংশ্লিষ্ট কোম্পানি রয়েছে। ১০ মেগাওয়াটের প্রকল্পে সর্বোচ্চ চারটি এবং ২৫ মেগাওয়াটের প্রকল্পে তিনটি দরপত্র জমা পড়ে।

বিদেশি অনাগ্রহের পেছনে কারণ কী?

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এমন অনাগ্রহের পেছনে বিশেষজ্ঞরা যে বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন, তার মধ্যে প্রধান হলো নীতির অস্থিরতা ও পূর্ববর্তী চুক্তিগুলোর একতরফা বাতিল।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’-এর আওতায় স্বাক্ষরিত ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর এতে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যারা ইতোমধ্যেই জমি অধিগ্রহণ, নকশা, অফিস স্থাপনায় অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।

এই পরিস্থিতিতে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, “এই বিডে (দরপত্রে) কোনো সার্বভৌম গ্যারান্টি ছিল না, যা আগের চুক্তিতে ছিল এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। হঠাৎ করে পুরো চুক্তির বাতিল ঘোষণা বিদেশিদের মাঝে আস্থা সংকট তৈরি করেছে, যার প্রতিফলন আমরা পিডিবির সাম্প্রতিকতম বিডে দেখছি।”

জমির সংকট, আর্থিক মডেলের দুর্বলতা এবং প্রকল্পে ব্যাংকের অর্থায়নের সুযোগ না থাকায় সম্ভাব্য দরদাতারা পিছিয়ে গেছেন বলেই তার অনুমান।

ফিনল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে কী শেখা যায়?

এই প্রসঙ্গে ফিনল্যান্ডের অউলু বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা করা জ্বালানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ খাইরুল এহেছান বলেন, “বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত, বিশেষত সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হ্রাস পাওয়া গভীরভাবে নীতিগত সংকেত বহন করে।

“ফিনল্যান্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রকৃত সক্ষমতা সূর্যরশ্মির প্রাচুর্যের চেয়ে অনেকাংশে নির্ভর করে প্রযুক্তি ও নীতির স্থায়িত্বের ওপর। আমাদের এখানে (ফিনল্যান্ডে) যেখানে শীতের দীর্ঘ সময়ে আলো সীমিত, সেখানে সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে মাইক্রোগ্রিড, স্টোরেজ এবং স্মার্ট কন্ট্রোল প্রযুক্তির সংযোজনের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের দক্ষতা বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “এখানে আমরা যেটা দেখতে পাই, তা হলো যেকোনো নবায়নযোগ্য প্রকল্পে পলিসি সার্টেনিটি এবং ব্যাংকেবল স্ট্রাকচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রকল্প তখনই টেকসই হয়, যখন বিনিয়োগকারী জানে সে কী ধরনের নীতি কাঠামোর আওতায় কাজ করছে এবং কী ধরনের রিটার্ন পেতে পারে।”

জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ সম্ভাব্যতা যেমন বেশি, সূর্যালোকের ঘনত্বও তুলনামূলকভাবে উচ্চ, তারপরও কেন বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে?

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সমস্যাটি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার চেয়ে নীতিগত অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে নিহিত। হঠাৎ করে একতরফাভাবে ৩১টি প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে এক ধরনের অস্থির ও অনিশ্চিত বাজার হিসেবে উপস্থাপন করেছে।”

এহেছানের মতে, বাংলাদেশের পিডিবি যদি পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়, তাহলে কয়েকটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি: ১. সার্বভৌম গ্যারান্টির স্পষ্টতা ২. টেকসই আর্থিক মডেল যা আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কাঠামোতে স্বীকৃত ৩. দীর্ঘমেয়াদী নীতির নিশ্চয়তা ও দরপত্রের স্বচ্ছতা ৪. স্থানীয় সহযোগীদের সাথে বিদেশি কোম্পানির যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক কাঠামো।

“বাংলাদেশ যদি এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারে, তবে ফিনল্যান্ডের মতো সূর্যালোক-স্বল্প দেশেও যেখানে সৌরবিদ্যুৎ কার্যকর, সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপ্লব ঘটানো সম্ভব,” যোগ করেন তিনি।

পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

এদিকে পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, তারা দরপত্র কম জমা পড়ার কারণ পর্যলোচনা করছেন। পাশাপাশি পরবর্তী রাউন্ডে যেন আরও বেশি দরদাতা পাওয়া যায় সেরকম সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন