পুলিশ আবার পুরনো চেহারায়

ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের মিছিলে নারীকর্মীদের ওপর চড়াও পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের মিছিলে নারীকর্মীদের ওপর চড়াও পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছিল বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা। চাকরি জাতীয়করণের দাবি তাদের। সেই দাবি জানাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে রওনা হয়েছিল তারা।

কিন্তু কয়েক গজ দূরে কদম ফোয়ারার সামনেই তাদের আটকে দেয় পুলিশ। বাধা ঠেলে যেতে চাইলে প্রথমে জলকামান থেকে ছোড়া হয় গরম পানি। তারপর চলে বেধড়ক লাটিপেটা।

এ তো গেল বুধবার দুপুরের চিত্র। তিন দিন আগে রোববার একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল শাহবাগে। সেদিন বেসরকারি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা ছিল বিক্ষোভে। জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে তারাও রওনা হয়েছিল মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিতে। তাদের শাহবাগে আটকে দিয়ে ব্যাপক পেটানো হয়, ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাস।

এই সব ছাপিয়ে গেছে মাঝের মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের ঘটনা। সেই বিক্ষোভ ছিল সারাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে মূলত শিক্ষার্থীদের সেই মিছিল শাহবাগ পেরিয়ে রওনা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের দিকে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে তা আটকে দেয় পুলিশ, সেখানে বাধে সংঘর্ষ। তারপর মিছিলকারীদের বেধড়ক পিটুনি।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের কাছেই বুধবার প্রাথমিক শিক্ষকদের মিছিলে ব্যাপক লাঠিপেটা করে পুলিশ।

এই পিটুনির হাত থেকে নারীরাও বাদ যায়নি। নারীদের পেটানোর দৃশ্য প্রচার ও প্রকাশের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) আবদুল্লাহ আল মামুনের ছবি ঘুরছে এখন ফেইসবুকের ওয়ালে ওয়ালে।

ছবির সঙ্গে মন্তব্যও চলছে। একজন ফেইসবুকে লিখেছেন- “আজকে ধর্ষণবিরোধী মিছিলে এসি মামুনের মাস্তানী দেখে তৎকালীন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের কথাই আমার মাথায় আসলো। এডিসি হারুনের প্রতিমূর্তি হিসাবেই প্রেক্ষাপটে হাজির হয়েছেন এসি মামুন।”

পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হয়েছিলেন হারুন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তার কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। উত্তাল জুলাইয়ে ছয়জন শীর্ষ সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিলেন তিনি।

সেই ছয়জনের একজন সারজিস আলম কিছু দিন আগেও এক সমাবেশে বলেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার পুলিশকে ‘টিস্যু’র মতো ব্যবহার করেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সেই সময়ে কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনই শুধু নয়, যে কোনো বিক্ষোভে চড়াও হতো পুলিশ। জুলাই আন্দোলনের সময় তাদের সেই ভূমিকা অতীতের সব সময়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পতনের পর আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পুলিশের পর।

পুলিশের ওপর একের পর এক আক্রমণ, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া- প্রাণ বাঁচাতে সব পুলিশ গিয়েছিল পালিয়ে। তিন দিন দেশে কোনো পুলিশই ছিল না। পুলিশশূন্য দেশ এই প্রথম দেখা গিয়েছিল।

তখন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহার করেছে।

সেই পুলিশকে বদলাতে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, তারা প্রতিবেদনও দিয়েছে। কিন্তু রাজপথে পুলিশকে আবার লাঠিয়ালের আচরণেই দেখা যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’র বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলাও করেছে পুলিশ।

তবে এর চেয়ে মজার বিষয় হলো পুলিশের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে মিছিল, যার নেতৃত্বে দেখা গেছে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়দের।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইন্টার কন্টিনেন্টালের ঘটনার পর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয় পুলিশের পক্ষে। একই রকম মিছিল হয় দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও।

‘Gen Z Bangladesh’ নামে একটি ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে লেখা হয়- “পুলিশের উপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছি, একই সাথে যারা পুলিশের উপর আজ হামলা চালিয়েছে। তাদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।”

আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতে গত বছরের অভ্যুত্থানে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল ‘জেন জি’ প্রজন্ম। সশস্ত্র পুলিশের মোকাবেলায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তারা। সেই সঙ্গে পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণেও তারা পিছপা হয়নি।

ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশকে মেরে ফুটব্রিজে লাশ ঝুলিয়ে রাখা, থানার ভেতরে পুলিশকে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল তখন।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এক পুলিশ সদস্যকে মেরে লাশ এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

অভ্যুত্থানে বিজয়ের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ এমন স্বীকারোক্তিও দেন যে পুলিশ তথা সরকারের মনোবল নষ্ট করতে তখন মেরে ফেলার পর পুলিশের লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো কাজও তারা পরিকল্পনামাফিকই করেছিলেন।

‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে যারা বিক্ষোভে ছিলেন, তারা জুলাই অভ্যুত্থানে যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি তাদের অনেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনেও ছিলেন।

তাদের সেই ভূমিকার কথা তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ হুঁশিয়ার করেছেন তাদের। এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন- “২০২৫ এ এসে ২০১৩ ফেরানোর চেষ্টা করবেন না। সাবধান!”

এসব দেখে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার একটি প্রশ্ন ছুড়ে ফেইসবুকে লিখেছেন- “ধর্ষকদের বিচার চাইলে সমন্বয়কদের কেন জ্বলে?”

এই পোস্ট দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২০১৩ সালে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে সরকারি বাহিনীর অভিযানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আমলে নিয়ে ইমরানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

এদিকে অনেকের চোখে পুলিশ যখন চেনা রূপে ফিরে গেছে; তখন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেপথ্যের কারিগর, তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন- “পুলিশকে সহযোগিতা করুন, এখন দরকার স্থিতিশীলতা’।

পতনের দুদিন আগে শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনে ভর করে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাই পুলিশকে কঠোর হাতে তা দমন করতে হবে।

আরও পড়ুন