পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে অপেক্ষা, এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সবারই আছে। সেই অপেক্ষার মূল কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশন বা যাচাই করে প্রতিবেদন দেওয়া। সেই যাচাই আবার হতো স্থায়ী ও বর্তমান উভয় ঠিকানায়ই। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এই যাচাইয়ের কাজটি করত।
সাধারণ মানুষের কাছে ভেরিফিকেশনের মানে ছিল পুলিশের দুজন সদস্য এই দুই ঠিকানায় যাওয়া আর নগদ নারায়ণ নিয়ে আসার। তা না দিলে প্রতিবেদন আসত না, তার সরকারবিরোধী রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কেউ হলে সেখানে দেওয়া হতো বিরূপ প্রতিবেদন। অথচ পাসপোর্ট পাওয়া যে কোনো নাগরিকের অধিকার হিসেবই স্বীকৃত।
২০০৭ -০৮ সালে সবার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দেওয়ার কথা উঠেছিল প্রথম। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেই দিয়েছিলেন, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের আর দরকার নেই। কিন্তু তার কথা ফলেনি।
২০১২ সালে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম পাসপোর্ট ইস্যুতে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল চেয়ে একটি নোটিস দিয়েছিলেন। তার আগে ২০১১ সালে পাসপোর্ট অধিদপ্তরও পুলিশ ভেরিভিকেশন বাতিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল।
২০১৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তখনকার কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান (বর্তমানে কারাবন্দি) বলেছিলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্রে কোনো ব্যক্তির নাম-ঠিকানাসহ সব ধরনের তথ্যই থাকে। তাহলে এখনো পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা কী?”
কিন্তু এত সব কথায়ও কাজ হয়নি। সব প্রস্তাব আটকে যেত পুলিশের কাছে গিয়ে। তারা নানা যুক্তি দেখাত পুলিশ ভেরিফিকেশন বহাল রাখতে।
এক্ষেত্রে বড় যুক্তি দেখানো হতো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়া ঠেকাতে। যদিও এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফাঁক গলে বহু রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র তো বানিয়েছেই, বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবসহ নানা দেশে গিয়ে ধরাও পড়েছে।
অবশেষে পাসপোর্ট তৈরিতে সেই পুলিশ ভ্যারিফিকেশন উঠল এ নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রায় দেড় দশক পরে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রোববার ঘোষণা দেওয়ার পর সোমবার পাসপোর্ট তৈরিতে পুলিশ েভরিফিকেশনের বাধ্যবাধকতা তুলে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের সার সংক্ষেপ অনুমোদন করেছেন বলে তার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে।
এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হলে পাসপোর্ট করতে আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হবে না। জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি দিয়েই পাসপোর্ট তৈরি করা যাবে।
আগের দিন ডিসি সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, “আমাকে যে জন্মসনদ দিয়েছেন, সেটা কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন দিয়ে করেননি। আমাকে এনআইডি দিয়েছেন, সেটাও কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি; নাগরিক হিসেবে পেয়েছি, এই দেশের নাগরিক। পাসপোর্টও এই দেশের নাগরিকের একটা পরিচয়পত্র। এখানে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না।”
এই বক্তব্যের পরদিনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেড় পাতার সার সংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিবেচনা এবং অনুমোদনের জন্য পাঠায়। তিনি তা অনুমোদনও করে দেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানান, জনভোগান্তি লাঘবে পাসপোর্ট সেবা সহজ করতে পরিপত্রে বেশ কিছু নির্দেশনা থাকবে।
১. নতুন পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাই করা জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দেওয়া হবে।
২. বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পাসপোর্টের নতুন আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জন্মনিবন্ধন সনদের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট দেওয়া হবে।
৩. পাসপোর্ট পুনঃ ইস্যুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাসপোর্টের সঙ্গে মৌলিক তথ্যের পরিবর্তন হলে জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু করা যাবে।
৪. পাসপোর্ট আবেদনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ডেটাবেজ বা জন্মনিবন্ধন ডেটাবেজের সঙ্গে যাচাই করা হলে তা বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩ এর ৫ (২) ধারার উদ্দেশে পূরণকল্পে প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষ হয়েছে বলে গণ্য হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবারের মধ্যে পরিপত্র জারি হবে। পরিপত্র জারির পর থেকে এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে।
পাসপোর্ট সেবাকে অন্যতম নাগরিক সেবা হিসেবে তুলে ধরে সার সংক্ষেপে বলা হয়, বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি নাগরিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে বিদেশে যান। এছাড়া উচ্চ শিক্ষা, স্থায়ীভাবে বসবাসসহ নানা উদ্দেশ্যে নাগরিকরা বিদেশে যান। বর্তমানে দেশে ও বিদেশের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ২৮ থেকে ৩০ হাজার আবেদন গ্রহণ এবং ২৫ থেকে ২৮ হাজার পাসপোর্ট ছাপানো হয়।
সার সংক্ষেপে জনভোগান্তির কথা তুলে ধরে বলা হয়, “বিদ্যমান ই-পাসপোর্ট সিস্টেমে পাসপোর্টের জন্য ঘরে বসে আবেদন দাখিল ও অনলাইনে ফি জমা দেওয়ার পর আবেদনকারীগণকে একটি নির্ধারিত দিনে বায়োমেট্রিক তথ্য প্রদানের জন্য এবং পরে পাসপোর্ট গ্রহণের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়।
“অনলাইন সিস্টেমে আবেদন দাখিলের পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠানোর পর ইতিবাচক পুলিশ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আবেদনকারীর অনুকূলে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে বর্তমান পদ্ধতিতে। কিছু পুলিশ ভেরিফিকেশন যথাসময়ে না পাওয়া বা পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনাবশ্যক কাগজপত্র যাচাইয়ের কারণে প্রায়ই আবেদনকারীদের ভোগান্তির অভিযোগ পাওয়া যায়।”
এদিকে যে কারণ দেখিয়ে এতদিন আপত্তি দিত পুলিশ, সেই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুযোগ রোহিঙ্গারা নিতে পারবে না।
“জনগণকে ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক দিনের চিন্তাভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নেওয়া ঠেকাতে সরকার ব্যবস্থা নেবে।”
রোহিঙ্গাদের কীভাবে পাসপোর্ট পাওয়া থেকে বিরত রাখা হবে- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে তাদের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন দরকার হবে না। রোহিঙ্গারা যেন এনআইডি না পায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের কেউ এনআইডি পেয়ে থাকলে সেটাও যাচাই করা হবে।”