অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখতে যখন ফেইসবুকে প্রচার চলছে, তখন নাহিদ ইসলামকে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সহযোদ্ধা হাসনাত আব্দুল্লাহ।
ইউনূসকে ক্ষমতায় রাখার প্রচারের পেছনে ভোট না করার ফন্দি-ফিকির রয়েছে বলে বিএনপিসহ রাজনৈতিক নেতাদের মনে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, নাহিদকে নিয়ে হাসনাতের পোস্টে দৃশ্যত তা আরও জোরাল হয়েছে।
নাহিদ প্রধানমন্ত্রী হবেন কোন প্রক্রিয়ায়? অনেকেই তুলেছেন সেই প্রশ্ন। তাহলে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে ক্ষমতায় আনার জোগাড়যন্ত্র চলছে কি না, সেই সন্দেহ করছেন অনেকেই।
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ মাড়িয়ে এখন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি হবেন বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বয়সী সরকার প্রধান। তার এখন বয়স ২৭ বছর।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব নেন নাহিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমন্বয়ক ছিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমও; যারা এখন এনসিপির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্বে রয়েছেন।
ওই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর নোবেলজয়ী ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নাহিদ তার উপদেষ্টার পদও নেন।
এরপর অভ্যুত্থানের তরুণ নেতারা নতুন দল এনসিপি গঠন করলে গত ফেব্রুয়ারিতে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলটির আহ্বায়কের পদ নেন নাহিদ।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়ে আসছিল; তখন এনসিপি নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়ার আওয়াজ তোলে। ইউনূসও সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলছেন।
জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া গঠিত একটি সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছিল রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে, তখন এনসিপির নেতারা তা উড়িয়ে দিতে নানা যুক্তি হাজির করেন।
এরমধ্যে গত ২৯ মার্চ সারজিস আলম এক ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মত একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।”
এরপরে একটি পক্ষ ইউনূসকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার পক্ষে ফেইসবুকে প্রচার শুরু করেন।
কিন্তু আল আজিরা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস আওয়ামী লীগের ভোটে আসা না আসা নিয়ে একটি মন্তব্যের পর ২৮ এপ্রিল সারজিসের অবস্থান অনেকটাই ঘুরে গেছে।
এদিন তিনি নিজের ফেইসবুক পাতায় দেওয়া একটি পোস্টে আরেকজনের বক্তব্য তুলে ধরেন; যেখানে বলা হয়, “ডক্টর ইউনূস গতকাল একটা রেড লাইন ক্রস করেছেন।”
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগই নেবে- ইউনূসের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে পোস্টে বলা হয়, “এই কথা বলার কোন অধিকার ডক্টর ইউনূসের নাই। কারণ, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, সেই ডিসিশন এই দেশের মানুষ নেবে।”
পোস্টের শুরুর সম্বোধনের ধরন পাল্টে শেষে লেখা হয়, “ইউনূস নিজেও যদি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলে, ইউনূসের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে আমরা এক সেকেন্ডও সময় নিবো না।”
সারজিস এই পোস্ট দেওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা আগে হাসনাত একটি পোস্ট দেন নাহিদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে। সেখানে তিনি লেখেন- “শুভ জন্মদিন। বাংলাদেশের আগামীর প্রধানমন্ত্রী নাহিদ ইসলাম।”
এক মাস আগে সারজিসের পোস্টে ইউনূসকে নিয়ে তার আকাক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু হাসনাতের পোস্টে কোনো ধরনের চাওয়া কিংবা আকাঙ্ক্ষার কথা নেই। সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার মতো করেই তিনি লিখেছেন নাহিদ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।
নাহিদকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে এনসিপিকে আগামী নির্বাচনে ১৫০টির বেশি আসন পেতে হবে।
পরবর্তী নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে বলে ইউনূস বলে আসছেন। সেই নির্বাচনে অংশ নিতে হলে এনসিপিকে নানা শর্ত পূরণ করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত হতে হবে।
এনসিপির নিবন্ধন পাওয়া নিয়ে কারো কোনো সংশয় না থাকলেও নির্বাচনে তাদের জয়ী হওয়া নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে অনেকেরই।
যে পোস্ট হাসনাত দিয়েছেন, তাতে ছয় ঘণ্টায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার জন। তার পোস্টের নিচে মন্তব্য জমা পড়েছে ৭৩ হাজারের বেশি।

সেই সব মন্তব্যে অনেকে শুভ কামনা জানালেও দিন দিন এনসিপির মিছিল ছোট হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই আশা পূরণ হওয়া নিয়ে অনেকেই নিজেদের সন্দেহের কথা জানিয়েছেন।
একজন লিখেছেন- “কীভাবে আগামীর প্রধানমন্ত্রী হবে জানি না? কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হতে তো ভোট লাগবে। আপনারা তো নির্বাচন চান না।”
ভোটের চেয়ে সংস্কারে গুরুত্ব এবং সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি তোলায় এনসিপিকে নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে।
দলটির নেতাদের সন্দেহ, নানা অজুহাতে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে এনসিপির সংগঠিত হওয়ার জন্য। আর স্থানীয় নির্বাচন আগে করে এনসিপি প্রভাব খাটিয়ে তাদের নেতাদের মেয়র-চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করে সংসদ নির্বাচনে সেই সুবিধা নিতে চাইছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এনিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেখানে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে, গণঅভ্যুত্থান করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য যদি এত অনিশ্চয়তা থাকে, সেটাকে আমরা স্বাভাবিক নয় বলেই মনে করি।”
নাম না ধরে তিনি বলেন, “আমরা কো-রিলেট করতে চাই যে কিছু কিছু নতুন রাজনৈতিক দল এবং পুরনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে নির্বাচন বিলম্বিত করার একটা পাঁয়তারা লক্ষ্য করা যায়। সে কারণে সরকারের বক্তব্য এবং তাদের কথা ও কর্মকাণ্ড -সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায় নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।”
বিএনপি মহাসিচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগেই বলেছিলেন, অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা সরকারে থেকে নতুন দল গঠন করে ভোট করলে সেই নির্বাচন অবাধ হবে না।
তার পরিপ্রেক্ষিতে নাহিদ নতুন দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে উপদেষ্টার পদ ছাড়লেও তার আন্দোলনের দুই সাথী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম এখনও সরকারে রয়ে গেছেন।
ইউনূস আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সেরা নির্বাচন জনগণকে উপহার দিতে চান। কিন্তু ছাত্রদের নতুন দল গঠন, সরকারে অংশগ্রহণ সব মিলিয়ে তার প্রতিশ্রুতিতে সংশয়াচ্ছন্ন করছে।
তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে হাসনাতের পোস্টের বিষয়ে নাহিদ অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও জানাননি।
নাহিদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি কয়েক বছর হলো। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেন তিনি, যার নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল হক নুর।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে সেই আন্দোলনের পর তারা ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দেয়। সেই প্যানেল থেকে সংস্কৃতি সম্পাদক পদে লড়েছিলেন নাহিদ। তিনি জিততে না পারলেও সেই প্যানেল থেকে ভিপি পদে নুর এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে আখতার হোসেন জয়ী হন।
নুর পরে গণঅধিকার পরিষদ নামে দল গঠন করেন। আখতার নুরের দল ছেড়ে গণতািন্ত্রক ছাত্র শক্তি নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সংগঠনে আখতার হন আহ্বায়ক, নাহিদকে করা হয় সদস্য সচিব।
২০১৮ সালের আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করেছিল। তা নিয়ে একটি রিট আবেদন হলে ২০২৪ সালের জুন মাসে হাই কোর্ট সব কোটা পুনর্বহালের আদেশ দিলে শিক্ষার্থীরা আবার ফুঁসে ওঠে।
নুর-আখতাররা ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ায় নতুন আন্দোলনে হাল ধরেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাহিদ। আন্দোলনের সময় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয় নাহিদকে। তিনিসহ ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল ডিবি অফিসেও।
জুলাই অভ্যুত্থানে প্রচারের আলোয় চলে আসা নাহিদ ক্রমে ছাপিয়ে যান আখতারকে। ফলে এনসিপি গঠনের সময় তিনি হন দলের আহ্বায়ক, আখতার হন সদস্য সচিব।