নিরাপত্তাহীনতায় জনসাধারণ: উন্নতি থমকে ‘কথামালা’ ও ‘দোষারোপে’

যৌথবাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোবাবেলার চেষ্টা করছে ইউনূস সরকার।
যৌথবাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোবাবেলার চেষ্টা করছে ইউনূস সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসের মাথায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে দিনেদুপুরে খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। আতঙ্কে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে মানুষ। যদিও তা মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। অবশ্য আইন উপদেষ্টা বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছেন।

সারাদেশ ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানেও আইনশৃঙ্খলার ‍উন্নতি না হওয়ায় যৌথবাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোবাবেলার চেষ্টা করছে ইউনূস সরকার।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা সদস্যদের বলেছেন, “নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ধৈর্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”

সোমবার সাভার সেনানিবাসে ফায়ারিং প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বল প্রয়োগ করা যাবে না। মাঝে মাঝে এই কাজগুলো করতে যেয়ে কিছু বলপ্রয়োগ হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “বল প্রয়োগ করতে গেলেও অত্যন্ত, একেবারে প্রোপোরশনেট যেন হয় এবং যত কম বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা যায়, ততই ভালো”

সেনাপ্রধানের এই মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভাল নয়, সেনাপ্রধানের মন্তব্যে তা স্পষ্ট। অনেকেই মনে করছেন, সেনাপ্রধান আসলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ইউনূস সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছেন।

যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর যেটুকু খারাপ হয়েছে এজন্য তিনি দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগকে।

রোববার গভীর রাত ৩টার দিকে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসে নিজ বাসভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবে হোক এটা প্রতিহত করা হবে।”

তিনি বলেন, “সোমবার থেকে যেন কোথাও কোনো অপরাধ না ঘটে, তারা সে ব্যবস্থা নেবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এই নির্দেশনা কার্যকর না করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও উন্নত হবে। অবনতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই আশ্বাস বাণীতে চিড়ে ভিজেনি দেশবাসীর। তার পদত্যাগের দাবিও জোড়ালো হচ্ছে। মধ্য রাতে যখন তিনি সংবাদ সস্মেলন করছিলেন তখনও তার পদত্যাগের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, সোমবার দুপুরে রাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা করে শিক্ষার্থী-জনতা। যদিও সেই আন্দোলনে পুলিশ বাধা দিয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন।

সোমবার ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ এই ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী-তরুণ ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এই গণপদযাত্রা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে যায়। কিন্তু শিক্ষাভবনের সামনে গণপদযাত্রা পৌঁছুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাধা দেয়।

এসময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন আন্দোলনকারীদের পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদ্রিতা রায়।

আদ্রিতা রায় বলেন, “আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে তার ব্যর্থতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে। তা না হলে আমরা আগামীকাল রাজু ভাষ্কর্য থেকে আমাদের সর্বোচ্চ জনবল নিয়ে মশাল মিছিল বের করবো। সে মিছিল থেকে আমরা আমাদের ৯ দফা বাস্তবায়নের লড়াই বেগবান করবো।”

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যতোই সাফাই গান না কেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অবশ্য সেই গানে গলা মেলাননি। বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যর্থতার দায় স্বীকারও করেছেন।

সোমবার দুপুরে রাজশাহীর পিটিআই মিলনায়তনে ‘দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ’ বিষয়ক কর্মশালায় আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের ব্যর্থতা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নাই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন যে আমাদের আত্মতুষ্টির সুযোগ নাই। তবে আমাদের চেষ্টা আছে এবং আত্ম-জিজ্ঞাসা আছে। ব্যর্থতা উত্তরণের জন্য আমাদের প্রচণ্ড চেষ্টা আছে, তাড়না আছে। প্রত্যেকটা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড চেষ্টা আছে।”

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দাবি করেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা নাজুক পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “রাজধানীসহ দেশের যেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, সেসব জায়গায় সন্ধ‍্যার পর থেকে যৌথবাহিনীর টহল বাড়ানো হবে, বাড়বে চেকপোস্টও।”

তিনি বলেন, “মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। খুব দ্রুতই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাবেন।”

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে পারে, সেজন্য তাদের মোটরসাইকেল দেওয়া হবে বলেও জানান প্রেস সচিব।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এখন যৌথবাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির কথা বলছেন অথচ গত ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে যৌথ বাহিনীর ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযান অব্যাহত আছে। ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে প্রায় ৮ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

গণপদযাত্রায় পুলিশের বাধা, পদত্যাগে ২৪ ঘণ্টা সময় পেলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করুন: সেনাপ্রধান ওয়াকার

কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর ঘাঁটির কাছে সংঘর্ষে তরুণ নিহত

দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় আওয়ামী লীগের দোসররা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মধ্যরাতে ঢাবিতে বিক্ষোভ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads