বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে না দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন বলে বিএনপি নেতারা কয়েক মাস আগেও অভিযোগ করছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলার দণ্ড থেকে মওকুফ পেলে এই প্রশ্ন এসেছিল, কবে বিদেশ যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন?
কোনো বাধা না থাকলেও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছিল, যা নানা কৌতূহলেরও জন্ম দিচ্ছিল। বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছিল, বিমানযাত্রার ধকল পোহানোর সক্ষমতা এখনও খালেদা জিয়ার হয়নি। তা হলেই বিদেশ যাবেন তিনি।
দৃশ্যত সেই সক্ষমতা পেয়েছেন তিনি। কেননা বিএনপির পক্ষ থেকে রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হল, চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাতে দেশ ছাড়ছেন খালেদা জিয়া। তিনি প্রথমে যাবেন লন্ডনে, সেখানে কয়েকদিন থেকে তারপর যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এদিন রাতে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসা ফিরোজায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী, জনগণের সবচেয়ে আদরের নেত্রী চিকিৎসার জন্য ৭ জানুয়ারি রাতে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন।”
বিএনপি নেতাদের উদ্ধৃত করে ঢাকার সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হাম্মাদ আল থানি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে রাজকীয় বহরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই বিমানে সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। এই বিমানেই রওনা হবেন খালেদা জিয়া।

ইন্টারনেটে বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, ২০১৫ সালে মাল্টার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য এমন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হাম্মাদ আল থানি।
ওই বছরের জুলাইয়ে বেইজিংয়ে সফরে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মাল্টার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ ভেলা। তখন কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তিনি মাল্টায় ফিরেছিলেন।
লন্ডন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে গেলে দলের দায়িত্ব নেন তার ছেলে তারেক রহমান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে তখন থেকেই দল পরিচালনা করে আসছেন তিনি।
তারেক রহমান সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পাওয়ার পর সেই ২০০৮ সালে যে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তারপর থেকে সপরিবারে সেখানেই রয়েছেন।
এরমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে একের পর এক মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। চারটি মামলায় তার সাজার ্রায়ও হয়। গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনটি মামলায়ই দণ্ড থেকে খালাস পান তিনি। অন্য সব মামলা থেকেও তিনি অব্যাহতি পাচ্ছেন।
সময় হলেই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন, একথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কেন তিনি ফিরছেন না, তা অনেকের কাছে প্রশ্ন।
আবার খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রায় দেরির পেছনে তারেক রহমানের ফেরার বিষয়টিও জড়িত বলে মনে করেন অনেকে।
এরমধ্যে দুদিন আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান। তার পরপরই তার বিদেশযাত্রার দিন-ক্ষণ জানানো হলো, যা এতদিন বিএনপি নেতারা জানাচ্ছিলেন না।
এই অবস্থায় খালেদা জিয়া আগে লন্ডন যাচ্ছেন, সেখানে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দেখা হবে।
২০১৬ সালে খালেদা জিয়া ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব গেলে তারেকও লন্ডন থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। তার পরের বছর খালেদা জিয়া লন্ডন গেলে সেখানে ছেলের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর আর ছেলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, এবার লন্ডন গিয়ে ছেলের বাসায় কয়েকদিন থাকার পর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি যেমন দেড় দশক পর চাপমুক্ত হয়েছে, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়কালে রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটির গুরুত্বও বেড়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমা্ন সরকারকে বিএনপি সর্বোত সহযোগিতা দিয়ে যাবে বলে তারেক রহমান জানিয়ে এলেও নির্বাচন নিয়ে এই সরকারের সঙ্গে বিএনপির মতভেদও স্পষ্ট হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের জন্য সময় নিতে চাইলেও বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এনিয়ে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদাতা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বও বাড়ছে। আবার এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপির মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশ যাচ্ছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে আসবেন, তাও ঠিক নেই; এই অবস্থায় বিএনপি চলবে কীভাবে?
খালেদা জিয়া কী নির্দেশনা রেখে যাচ্ছেন- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “ম্যাডাম নির্দেশনা দিয়েছেন যে এক সাথে কাজ কর, জনগণের পক্ষে কাজ কর, গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ কর।”
খালেদা জিয়ার বিদেশে অবস্থানের মেয়াদ কত দিন হবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা তো চিকিৎসকরা বলতে পারবেন। আমরা তো বলতে পারি না। আমরা আশা করি, উনি চিকিৎসা শেষে খুব শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন।”
নেবেন কীসের চিকিৎসা?
৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস,কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন।
আওয়ামী লীগ সসরকার আমলে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যেতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। দুই বছর পর কোভিড মহামারি দেখা দিলে ২০২০ সালের মার্চ মাসে নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে শর্ত ছিল- তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
মুক্তি পেয়ে তখনই গুলশানের বাসায় উঠেছিলেন খালেদা জিয়া। তবে অসুস্থতার জন্য তাকে মাঝে-মধ্যেই হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল।
হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে গত বছরের মাঝামাঝিতে তাকে পেসমেকারও বসাতে হয়।
তার আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। তখন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন চিকিৎসক।
তারা তখনই বলেছিলেন, এর চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন। এখন তা করাতেই যুক্তরাষ্ট্রের যাচ্ছেন তিনি।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি কেয়ার ইউনিটে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে খালেদা জিয়ার। এরই মধ্যে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজও সেখানে পাঠানো হয়েছে।
ওই হাসপাতালের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসে এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখেও গিয়েছিলেন। তাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলই বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করাবেন।