‘শাস্তি’র শঙ্কায় ডিসি হতে অনীহা!

bd logo

মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য আকর্ষণীয়। কর্মকর্তাদের একাংশ সব সরকারের সময়েই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জ্যেষ্ঠ আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে ডিসি হতে তদবির করতেন।

ব্যতিক্রম ছিল না অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও। এই সরকারের প্রথম দিকে ডিসি হতে রীতিমত বিক্ষোভ ও হট্টগোল করেছিলেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। কিন্তু হঠাৎ করেই এই চিত্র পাল্টে গেছে।

তদবির করা তো দূরের কথা ডিসি হওয়ার জন্য সাক্ষাৎকার দিতেও যাচ্ছেন না প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ডিসি নিয়োগে কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। সেখানে অনুপস্থিতির হার ৪৯ শতাংশ।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও শাস্তি দেওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ করা সব ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়।

খালি হওয়া পদগুলোয় নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছিল। তখন ১৭ কর্মকর্তাকে শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল।

ডিসি নিয়োগ নিয়ে তদবির ও সমন্বয়ক দাবি করা এক ব্যক্তির প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও উঠেছিল।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রশাসনের ৪৩ কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ডিসি হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এ ছাড়া ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারী (চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে) ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ডিসি নিয়োগে সাক্ষাৎকার নিতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করো হয়েছে। যার প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ কমিটি গত জানুয়ারি থেকে নতুন ডিসি নিয়োগের জন্য কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ডিসি নিয়োগের জন্য এবার প্রশাসন ক্যাডারের ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রায় ৪০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হয়েছে।

ডিসি পদে নিয়োগ দিতে ২৫তম ব্যাচের ১১৫ জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। এর মধ্যে সাক্ষাৎকার দিতে যান ৬১ জন, অর্থাৎ ৫৩ শতাংশ কর্মকর্তা সাক্ষাৎকারে অংশ নেন।

২৭তম ব্যাচ থেকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয় ১৫৪ জনকে। এর মধ্যে উপস্থিত হন ৭৫ জন, অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার দিতে যান।

সাক্ষাৎকারের অপেক্ষায় আছেন ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। সে ব্যাচ থেকেও উপস্থিতি কম হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ ও ২৭তম ব্যাচে ৫০০ জনের মতো কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের সবাইকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়নি। এবার সাক্ষাৎকারে উপস্থিতি বাধ্যতামূলকও করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক কর্মকর্তা বলছেন, এখন ডিসি হলে বিপদ আছে। একে তো মাঠ প্রশাসনে নানা রকম চাপ। তার ওপর ভবিষ্যতে শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে।

অনেকে ব্যক্তিগত কারণ সামনে এনেছেন, সেই সঙ্গে নানা শঙ্কার কথা তুলে ধরেন তারা। বলেছেন, মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করলে প্রশাসনের শীর্ষ পদে যাওয়ার সুযোগ বাড়ে। দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, কিন্তু এখনকার অভিজ্ঞতা বলছে, ঝুঁকি অনেক বেশি।

তাদের ভাষ্য, বিগত তিনটি নির্বাচনের সময়ে ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারা এখন জবাবদিহির মুখে পড়ছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেকেরই সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন ডিসি হলে আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে। কোনো না কোনো সময় তাদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।

এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মাঠ প্রশাসনের ওপর নানাভাবে চাপ তৈরি করছেন। সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে কাজে হস্তক্ষেপ ও তদবির করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ‘মব’ (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) তৈরি করা হচ্ছে। ফলে স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন বলে মনে করছেন তারা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ডিসি পদে দায়িত্ব পালনকারীদের পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার কী চোখে দেখবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে কারও কারও।

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান সাংবাদিকদের বলেন, “বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতে দেয় রাষ্ট্র। ডিসি তো ভোটবাক্স ছিনতাই, বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করার সঙ্গে যুক্ত থাকতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু তার পরও ভোটে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বিরুদ্ধে যেভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের চাকরি নেই, ওএসডি করা হয়েছে তাতে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে তো আতঙ্ক তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ কারণে ডিসি হওয়ার আগ্রহ অনেকের নাও থাকতে পারে।”

এবিষয়ে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন, দুর্নাম হতে পারে—এ ভয়ে ডিসি হতে না চাওয়া অস্বাভাবিক নয়।”

তিনি বলেন, “আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর মাঠ প্রশাসনে অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা ডিসি হয়ে যেতে চাইবেন না। রাজনৈতিক সরকার যদি মাঠ প্রশাসনে ডিসিদের ওপর খবরদারি বন্ধ করে এবং তাদের পেশাদারির সঙ্গে কাজ করতে দেয়, তখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি হবে।”

আরও পড়ুন