উদ্বাস্তু হয়ে থাকা ১৩ লাখ রোহিঙ্গা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে, এমন সতর্ক বার্তা দীর্ঘদিন ধরেই দিয়ে আসছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এবার কি তাই ফলতে চলছে?
বিবিসি বাংলা সরেজমিনে কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছে, রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের এখনকার নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জিহাদে নামতে চাইছেন।
আর তা যদি ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য তা বড় ঝুঁকি তো হবেই, তার সঙ্গে আবার রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, যারা বিশ্বের নানা সংঘাতের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কটের ওপরও নিবিড় নজর রেখে আসছে।
গৃহযুদ্ধপীড়িত মিয়ানমারের অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণই হারিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। গত বছর বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের কতৃর্ত্ব নেয় বৌদ্ধ নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি, যারা রাখাইনে ‘স্বাধীন আরাকান’ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায়।
মুসলমান রোহিঙ্গাদেরও কয়েকটি বিদ্রোহী দল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এছাড়া রয়েছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামিক মাহাজ, রোহিঙ্গা ন্যাশনাল আর্মি (আরএনএ) এবং আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ)।
মিয়ানমারের জান্তা সরকার চীন ও রাশিয়ার আশির্বাদপুষ্ট। বিপরীতে বিভিন্ন রাজ্যে লড়াইরত আঞ্চলিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিদ্রোহীদের সরকারে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর।
আঞ্চলিক শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত মাঝামাঝিতে থেকে মিয়ানমারে তার স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে।
রোহিঙ্গাদের দলগুলোর কারও কারও সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। তার সেতুবন্ধন হিসাবে পাকিস্তান কাজ করে বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাখাইন নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক নানা আলোচনা শুরু হয়। রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে উদ্যোগী ছিলেন ওয়াশিংটনঘেঁষা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, যদিও দেশে ব্যাপক বিরোধিতার মধ্যে তা আপাতত চাপা পড়েছে।
এই জটিল অবস্থার মধ্যে এখন রোহিঙ্গারা যদি জিহাদে নামতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে, তা বলাই যায়।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যুদ্ধে নামার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
সে হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা ঘটছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইসলামি সংগঠনের নামে তৎপরতা বেড়ে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইসলামি মাহজের ডাকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের বড় সমাবেশ হয়।
এখন রোহিঙ্গাদের জিহাদে নামতে কারা উসকানি দিচ্ছে, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
কী হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে?
বাংলাদেশে যে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে, তাদের বেশিরভাগই রয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে। ৩৬ হাজারের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে তাদের ভাসানচরে সরানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু তখন জাতিসংঘ সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল আপত্তিতে তা বাধাগ্রস্ত হয়।

মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস প্রায় ৫ দশকের। তবে তা ছিল অল্প পরিমাণে এবং দীর্ঘদিন পরপর।
তবে ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলেও এক ধাক্কায় ৮ লাখের মতো রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে।
এই শরণার্থীদের মূল আবাস কক্সবাজারে গিয়ে বিবিসি বাংলা তাদের রণপ্রস্তুতির মনোভাব জানতে পেরেছে।
শরণার্থী শিবিরে একজন রোহিঙ্গা যুবক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এদিকে থাকব না। আমরা মিয়ানমারে চলে যাব। প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও ওইটা নিয়া আমরা স্বাধীন করে থাকব। আমরা যুদ্ধ করব আরাকান আর্মির সাথে। আমরা স্বাধীন (স্বাধীনতা) চাই।”
উখিয়া ক্যাম্পে আরেক যুবক বলেন, “আমাদেরকে যুদ্ধ করে নিজ দেশে স্বাধীনতা অর্জন করতে বলতেছে আরকি। সবাই জিহাদ করার জন্য তৈয়ার। এটার জন্য সবাই একতালে আরসা, আরএসও- দুনো দল (দুই দলই) সবাই মিলে ভালো কাজ করতেছে।”
ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, অন্তত চারটি সংগঠন আরসা, আরএসও, ইসলামিক মাহাজ ও এআরএ রোহিঙ্গাদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করছে। ক্যাম্পে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা থেকে খুনোখুনিও হয়েছে অনেক। আরসা ২০২১ সালে খুন করেছিল আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মুহিব্বুল্লাহকে, যিনি রোহিঙ্গাদের দাবি নিয়ে তার কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ অবধি গিয়েছিলেন।
তবে এখন আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়তে নিজেদের দ্বন্দ্ব ভুলে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো এক হয়েছে বলে শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন।
কুতুপালং ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গা বলেন, বৈঠকে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত না হওয়ার বিষয় এবং নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। সবাইকে সচেতন করা হয়।
“প্রতি জায়গায় জায়গায় মিটিং করে। মিটিংয়ে এটা বলে যে, আমাদের যে রাইট, যদি সঠিকভাবে পাই, নিরাপত্তার ভিতরে থাকতে পারি, আমরা মিয়ানমারে চলে যাব। মিটিংয়ের মাঝে বলে যে এটা আমাদের দেশ না। এখানে কোনো ঝগড়া চলবে না। সবাই একমতে থাকব।”
জিহাদ কেন?
রোহিঙ্গা মুসলিমদের জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত করতে বিভিন্ন সময় ইসলামী এনজিওর ছদ্মাবরণে কাজ করার খবর নানা সময়ে এসেছিল। আওয়ামী লীগ আমলে সেজন্য কয়েকটি এনজিওর কক্সবাজারে কাজ করার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
আরএসওর সঙ্গে বিভিন্ন সময় আল কায়দার যোগাযোগের খবরও আসে। ২০০২ সালে আফগানিস্তানে সিএনএন আল-কায়দার
কয়েক ডজন ভিডিওটেপ পায়, যেখানে রোহিঙ্গাদের আফগানিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার দৃশ্য ছিল। রোহিঙ্গাদের পাকিস্তানে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে আত্মঘাতী হামলা চালানোর খবরও তখন বের হয়।
আবার আরসার সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর যোগাযোগের নানা খবরও বিভিন্ন সময় আসে।

নিপীড়িত মুসলিম রেহিঙ্গাদের ধর্মভাব কাজে লাগিয়ে তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জিহাদের দিকে নেওয়া হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছে। তারা বলছে, দ্বন্দ্ব স্থগিত করে রোহিঙ্গা দলগুলো নতুন সদস্য সংগ্রহে নেমেছে এবং ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে শরণার্থীদের রাখাইনে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।
এই প্রবণতা গত এক-দেড় বছর হলো দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইসিজির প্রতিবেদনের লেখক এবং গ্রুপের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক টমাস কেইন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা সৃষ্টির জন্য তৎপরতা চলছে গত এক-দেড় বছরে। সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকদের দ্বারা ক্যাম্পে যে বর্ণনাটি ছড়ানো হচ্ছে, তা হলো- আমাদের ফিরে গিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং আমাদের মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার করতে হবে।”
প্রশিক্ষণও চলছে
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৈঠক এবং সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইসিজির প্রতিবেদনে।
টমাস কেইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ক্যাম্পে গোপনে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। কিছু শারীরিক প্রস্তুতির মতো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে হয়েছে—যেখানে অস্ত্র ব্যবহার হয়নি, বরং ব্যায়াম বা ড্রিলের মতো কার্যক্রম হয়েছে।
“তবে সম্প্রতি আমরা কিছু শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি, যারা বলেছেন তারা এমন লোকদের চেনেন, যাদের সীমান্ত এলাকার ক্যাম্পের বাইরে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। তাই আমরা যথেষ্ট নিশ্চিত যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কিছু মাত্রার সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে। বিশেষ করে আরসার মতো গোষ্ঠীগুলোর সীমান্ত এলাকায় নিজেদের ক্যাম্প রয়েছে।”
তবে বাংলাদেশে ক্যাম্পের ভেতর কোথাও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ হয় না বলে জানিয়েছে স্থানীয় বাংলাদেশি এবং ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা।
একজন রোহিঙ্গা বলেন, সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য অনেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্যাম্পের বাইরে সীমান্ত পাড়ি দেয়।
“মিয়ানমারে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়, এখানে কোনো প্রশিক্ষণ হয় না। ওরা মিয়ানমারে যেয়ে ওদিকে এক বছর থেকে, দুই বছর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছুটি নিয়ে আসে।”
কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফজুড়ে ৩৩টি ক্যাম্পে বাসরত ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গার ৩৪ শতাংশই বয়সে তরুণ। তাদের তৎপরতার বিষয়টি স্থানীয় বাংলাদেশিদেরও নজরে এসেছে।
স্থানীয় বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রবিউল হোছাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ক্যাম্পের মধ্যে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের অ্যাকটিভিটির মাধ্যমে জানতে পারছি। বিশেষ করে কারাতে প্রশিক্ষণের কথা জানতে পেরেছি।
“আরসা-আরএসও’র হয়ে বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে ৫০ বা ১০০ বা ২০০ জন বাংলাদেশ-মিয়ানমারে সীমান্ত পার হয়ে যুদ্ধ করতে মিয়ানামারে অনুপ্রবেশ করে বলে আমরা জেনেছি। অনেক সময় আমরা দেখেছি তারা ফিরে আসে।”
বাংলাদেশের বড় ঝুঁকি
রাখাইনে গত বছর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে প্রায়ই গোলা এসে পড়ত। নাফ নদীতে বাংলাদেশি নৌযান চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নাফ নদীতে বাংলাদেশি জেলেদের বিচরণ সীমিত হয়ে পড়েছে। মাঝে-মধ্যেই জেলেদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে আরাকান আর্মি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাতায়াতেও বিঘ্ন ঘটছে তাদের কারণে।
এখন বাংলাদেশে থেকে যদি রোহিঙ্গারা যুদ্ধে নামতে চায়, তাহলে আরাকান আর্মি যে তা ভালো চোখে দেখবে না, সেটাই স্বাভাবিক।

টমাস কেইন বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা তৎপরতা সম্পর্কে আরাকান আর্মি অবগত রয়েছে এবং এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।
“তাদের ক্যাম্প থেকে তথ্য পাওয়ার ভালো সোর্স রয়েছে, তাই তারা জানে ক্যাম্পে কী ঘটছে। তাদের ধারণা হলো, বাংলাদেশ—বিশেষ করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো—রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন দিচ্ছে। এটি আরাকান আর্মি ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ বা ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে একটি বড় বাধা। এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরাকান আর্মির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।”
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে হারিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গারা দাঁড়াতে পারবে না বলেই মনে করেন কেইন। আর সেটা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হবে তার আশঙ্কা।
“ক্রাইসিস গ্রুপের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বার্তা, কারণ এই বিদ্রোহ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সফল হবে না—যে বাহিনী মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছে। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, সাধারণ নাগরিক এবং উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। এর পরিণতি হবে সত্যিই ধ্বংসাত্মক।”
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। কিন্তু রোহিঙ্গা দলগুলোর তৎপরতা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে রোহিঙ্গারা দাবার ঘুঁটি হচ্ছে। জান্তা সরকার যুদ্ধে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায়। রোহিঙ্গারাও এখন আরাকান আর্মিকেই তাদের প্রধান শত্রু মনে করছেন।
সেটাও বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপদ ডেকে আনবে বলে আইসিজির আশঙ্কা।
টমাস কেইন বলেন, “এখনো উত্তর রাখাইন রাজ্যে এক থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষ রয়েছেন—যদিও সঠিক সংখ্যা জানা নেই—এবং তারা এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাঝখানে আটকে পড়বেন। আমরা তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি এবং তারা রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থক নন।
“তারা বিদ্রোহ সমর্থন করেন না, কারণ তারা জানেন এর পরিণতি কী হবে? তারা মাঝখানে পড়ে যাবেন এবং সম্ভবত তাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে হবে। ফলে, যদি উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত বেড়ে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে আরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় দিতে হতে পারে।”
তৎপরতা চললেও বাংলাদেশ সরকার কখনো কক্সবাজারের ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাদের কোনো তৎপরতায় সরকারের সমর্থন নেই বলেও দাবি করেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, “আরসা, আরএসও এগুলো তো বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংগঠন না। আর বাংলাদেশের ভূমিতেও এগুলো তৈরি হয়নি। এগুলো মিয়ানমারের অর্গানাইজেশন। মিয়ানমারে হয়েছে। এখন মিয়ানমারে তারা কী করবে না করবে এর দায় দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারি না।
“আমরা আমাদের টেরিটরিতে যেকোনো ধরনের ইলিগ্যাল আর্মস ডিলিং, ইলিগ্যাল আর্ম গ্রুপের অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করি না। দ্যাট ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।”
বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনি দেখুন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কী করেছে। সো কলড মিলিট্যান্ট গ্রুপ বলা হয় আরসা, তাদের প্রধানকে বাংলাদেশ গ্রেপ্তার করেছে, তাকে জেলখানায় পুরে রেখেছে। তারপর আরেকটি অর্গানাইজেশন যে আরএসও, তার পলিটিক্যাল প্রধানকে বাংলাদেশ গ্রেপ্তার করে জেলখানায় পুরে রেখেছে। বাংলাদেশ যদি তাদেরকে উসকে দিত, তাহলে বাংলাদেশের এই ভূমিকা থাকার কথা না।”
মিজানুর বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির বিরোধের ব্যাপারটি ঐতিহাসিক এবং সম্প্রতি এটি আরও প্রবল হয়েছে রাখাইনে যুদ্ধের বাস্তবতায়। তবে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এখন আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
উখিয়া টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের দুই হাজারের বেশি সদস্য। কক্সবাজারে অবস্থিত এপিবিএনের ডিআইজি প্রলয় চিসিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে যে কোনো সশস্ত্র গ্রুপের তৎপরতা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
ক্যাম্পে বিভিন্ন সময় অস্ত্র পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “যারা অপরাধী, তাদের কাছে অস্ত্র আছে। আমরা অ্যারেস্ট করছি। উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে হ্যান্ডমেইড, অটোমেটিক বা এসএমজি টাইপেরও আছে। এ ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, কোথা থেকে কীভাবে এগুলো এসেছে।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর: