সাইফকে ছুরিকাঘাত : বাংলাদেশি শরিফুলকে কি ফাঁসানো হচ্ছে?

সাইফ আলী খানের ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার শরিফুল ইসলাম শেহজাদ।
সাইফ আলী খানের ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার শরিফুল ইসলাম শেহজাদ।

মুম্বাইয়ের সুরক্ষিত বাড়িতে ঢুকে বলিউড তারকা সাইফ আলী খানকে ছুরিকাঘাতের পর এক বাংলাদেশিকে ধরে একে চুরির ঘটনা বলেই চালিয়ে দিচ্ছিল ভারতের পুলিশ। কিন্তু পুলিশ যা বলছে, আসলেই তাই কি না, তা নিয়ে ভারতেই দেখা দিয়েছিল সন্দেহ।

গ্রেপ্তার বাংলাদেশি শরিফুল ইসলাম শেহজাদের বাবা সেই সন্দেহ দিলেন আরও চড়িয়ে। তিনি দাবি করেছেন, শরিফুলকে মহারাষ্ট্র পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে যাকে দেখা যাচ্ছে, সে তার ছেলে নন, অন্য কেউ। 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে যখন অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, তখন মহারাষ্ট্র পুলিশ সাইফের ওপর হামলার ঘটনাটির দ্রুত সমাধানের কৃতিত্ব নিতেই শরিফুলকে ফাঁসাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও প্রশ্নও উঠেছে।

গত ১৫ জানুয়ারি গভীর রাতে মুম্বাইয়েঢর বান্দ্রায় পতৌদি পরিবারের ‘নবাব’ সাইফের বাড়িতে ঢুকে তার ওপর হামলা চালায় এক দুর্বৃত্ত। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে সাইফকে রক্তাক্ত করে পালিয়ে যায় হামলাকারী।

ছুরির ৬টি জখমের চিহ্ন নিয়ে সাইফ কোনোমতে পৌঁছান লীলাবতী হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার করে তার শরীর থেকে বের করা হয় ভাঙা ছুরির টুকরা। এরপর সাইফকে রাখা হয় আইসিইউতে। ছয় দিন পর বাড়িতে ফেরেন তিনি।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি ও বলিউড তারকা শর্মিলা ঠাকুরের ছেলে সাইফের ওপর হামলার পর আসামি গ্রেপ্তারে চিরুনি অভিযান শুরু করে পুলিশ।

তিন দিন পর মহারাষ্ট্রের থানে এলাকার একটি শ্রমিক বসতি থেকে বাংলাদেশি যুবক শরিফুলকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়। প্রথমে কোনো তথ্য প্রমাণ না দেখিয়েই বলে দেয়, এই যুবক বাংলাদেশি।

পরে শরিফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে পুলিশ জানায়, অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা শরিফুল চাকরি হারিয়ে চুরি করতে ঢুকেছিলেন সাইফের বাড়িতে। এটা যে বলিউড তারকা সাইফ ও কারিনা কাপুরের বাড়ি, তা তিনি জানতেন না।

সাইফ আলী খান

সাইফকে ছুরিকাঘাতের কারণ হিসাবে বলা হয়, প্রথমে এক গৃহকর্মী শরিফুলকে বাধা দিতে চাইছিলেন। এক পর্যায়ে সাইফ এসে পড়লে তাকে ছুরিকাঘাত করেন শরিফুল। তারপরও সাইফ তাকে বাথরুমে আটকে ফেললে তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের জন্য করা ফোঁকর গলে পালিয়ে যান।

শরিফুলের বাবার ভিন্ন দাবি

গ্রেপ্তার শরিফুলের ছবি ভারতের সংবাদমাধ্যমে দেখে ছেলেকে শনাক্ত করেন বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলায় থাকা তার বাবা রুহুল আমিন।

তবে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার যুবক তার ছেলে শরিফুল হলেও সাইফের বাড়িতে হামলাকারী হিসাবে সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে যাকে দেখো যাচ্ছে, সে অন্য কেউ।

রুহুল আমিনের তিন ছেলের মধ্যে শরিফুল দ্বিতীয়। গ্রেপ্তারের আগের শুক্রবার ছেলের সঙ্গে তার সর্বশেষ ফোনে কথা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

রুহুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফুটেজে যে ছবি দেখলাম, তারপরে মনে হইলো একই ধরনের না। আমার ছেলেকে অ্যারেস্ট করছে। আর ছবির ওই ছেলে একই না, একটু তফাৎ।”

শরিফুলের সঙ্গে ভিডিওর ব্যক্তির পার্থক্য কোথায়- তা বোঝাতে তিনি বলেন, “সে (শরিফুল) ছোটবেলা থেকেই চুল ছোট রাখে এবং ব্যাকব্রাশ করে। মানে চুলটা একটু উপরের দিকে থাকে। আর ওই ফুটেজের যে ছবি সে চোখের ভ্রু পর্যন্ত চুল নামানো। এরপর দেখলাম চেহারা ছবিতে মেলে না।”

অন্য কারও সঙ্গে মিলিয়ে তার নির্দোষ ছেলেকে ভারতীয় পুলিশ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। আর মাত্র ৯/১০ মাস আগে ভারতে যাওয়া শরিফুলের পক্ষে সাইফ আলী খানের মতো তারকার বাড়িতে হানা দেওয়ার সাহস হওয়ার কথা নয় বলে তার মত।

“সাইফ আলী খান, শাহরুখ খান, সালমান খান! এরা মন্ত্রী- এমপিদের মতো। এরা সুপারস্টার। এদের কাছে যাওয়া তো কঠিন!”

শরিফুলের ভারত যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতিও একটি কারণ বলে বেরিয়ে এসেছে তা্র বাবার কথায়। তিনি বলেন, স্থানীয় বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির সদস্য শরিফুলের বিরুদ্ধে কিছু মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলে। তাই তার ছেলে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে তার কয়েক মাস পর আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও শরিফুল দেশে না ফিরে ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন বলে জানান তার বাবা।

তিনি বলেন, তার ছেলে মুম্বাইয়ে ‘বার’ ধরনের হোটেলে কাজ নিয়েছিলেন এবং প্রতি মাসের ১০ তারিখের পর বেতনের কিছু টাকা দেশেও পাঠাতেন।

ভারতে অন্য সন্দেহ

এদিকে শরিফুলকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়া হলে দুজন আইনজীবী তার হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা বলেন, শরিফুল যে বাংলাদেশি নাগরিক, এমন কোনো প্রমাণ পুলিশ হাজির করতে পারেনি।

এই আইনজীবীদের একজন সন্দীপ শেরখান সেদিন দাবি করেন, শরিফুল বহু বছর ধরে মুম্বাইতে নিজের পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করছেন। ফলে মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকেছেন, এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

শরিফুলের বিএনপি পরিচয় প্রকাশের পর তা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক চলছে। অনেকেই পুলিশের এত তড়িঘড়ি করে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বর্ণনা করাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে।

বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্তও গড়িয়েছে। মহারাষ্ট্রের বন্দরমন্ত্রী, শিব সেনা নেতা নীতেশ রানা অভিনেতা সাইফের আহত হওয়া নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পরে সাইকে দেখে তার মনে হয়েছে, সবটাই অভিনয়।

আহত সাইফকে কে হাসপাতালে নিয়েছিল, তা নিয়ে নানা তথ্যে উঠছে সন্দেহ।

প্রথমে বলা হয়েছিল, সাইফের বাড়িতে গভীর রাতে কোনও গাড়িচালক ছিল না বলে তার ছেলে ইব্রাহিম তাকে একটি অটো রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

যে অটোতে করে সাইফ ২ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে গেলেন, তার চালক শতগুরু শরণ বলেছেন, সাইফ আলী খানের সঙ্গে ছিল তার অল্পবয়সী ছেলে এবং তাদের সঙ্গে ছিল আরেকজন, যার নাম হরি।

এদিকে হাসপাতালের খাতায় লেখা আছে, সাইফকে নিয়ে আসেন আফসার জায়েদি, যিনি সাইফের ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেন।

সাইফ ছুরিকাঘাতের শিকার হন রাত ২টা ৩০ মিনিটে; কিন্তু তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ভোর ৪টা ১১ মিনিটে। দুই কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিতে এত সময় লাগল কেন, তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।

শরিফুলের বাবার বক্তব্য শোনার পর মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সভাপতি নানা পাটোলেও পুলিশের বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তি আর সিসি ক্যামেরায় দেখা যাওয়া ব্যক্তি এক বলে তার মনে হচ্ছে না। পুলিশকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।

পুলিশ বলছে, ভিডিওর ব্যক্তি ও শরিফুল একই ব্যক্তি বলে তাদের চোখের দেখায় মনে হলেও এটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তবে তা এখনও তারা করতে পারেনি।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাইফের বাড়িতে পাওয়া আঙুলের ছাপ ও শরিফুলের আঙুলের সঙ্গে মিলে গেছে। হামলায় ব্যবহৃত ছুরির হাতলসহ তৃতীয় টুকরোটি অভিনেতার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে বান্দ্রা তালাওয়ের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে। এই ছুরির একটি টুকরো সাইফের বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল। আর ফলাটি ভেঙে গেঁথে গিয়েছিল তার মেরুদণ্ডে।

আরও পড়ুন